.
ঠিক এইরকম ক্ষেত্রে মনঃসমীক্ষণ অত্যাধিকভাবে কার্যকর, কারণ তা মানুষের অচেতন মনে যে পক্ষপাতিত্ব বোধ আছে সে সম্বন্ধে ওয়াকেফহাল করে। অন্যেরা যেমন আমাদেরকে দেখে এই পদ্ধতিতে, ঠিক তেমনি আমরাও নিজদেরকে দেখতে পাই এবং আমাদের মতামতের কারণ বিশ্লেষণ করে জানতে পারি ওসবে যত গুরুত্ব আমরা দিয়ে থাকি আদতে তত গুরুত্বপূর্ণ নয়। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে এই পদ্ধতি ব্যাপকভাবে শিক্ষা দিলে মানুষকে বাস্তবে ঘটনা এবং প্রস্তাবিত কোন কর্মের ক্রিয়াশীলতার প্রতি অধিকতর বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন করা যায়। এসবে মানুষ যদি দ্বিমত পোষণ না করে তাহলে যে ধরনের মতদ্বৈধতার অবকাশ থাকে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে তার মীমংসা সম্ভবপর।
এরপর যে অবশিষ্টাংশটুকু বর্তমানে থেকে যাবে তার সমাধান নিখুঁত বুদ্ধিবৃত্তিক পদ্ধতিতে সম্ভব নয়। একজন মানুষের আকাঙ্ক্ষা সর্বাংশে অন্য একজন মানুষের সঙ্গে মিল খায় না। স্টক এক্সচেঞ্জের দুজন প্রতিযোগী এ ব্যাপারে সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ এক মত হলেও যতক্ষণ একে অন্যের বদৌলতে ধনী হওয়ার আকাঙ্খ। পরিত্যাগ না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের মধ্যে ঐক্যের প্রতিষ্ঠা হতে পারে না। এরকম বহু বিপত্তি এই বিশেষ স্থানে এড়িয়ে যেতে পারে। ভাবাবেগের তাগিদে মুখের আক্রোশে নাক কেটে ফোল এরকম একজন মানুষকে আমরা বিচারবুদ্ধি রহিত বলে আখ্যা দিতে পারি। সে বিচারবুদ্ধিরহিত, কেননা বর্তমান মুহূর্তের উগ্র আকাঙ্খা চরিতার্থ করার জন্য ভবিষ্যতের প্রয়োজনীয় আকাঙ্ক্ষাকে ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলে। মানুষ যদি বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন হতে পারে তা হলে বর্তমানে যা করে ভবিষ্যতে তার চেয়ে নির্ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। যদি প্রত্যেক মানুষ জ্ঞাতভাবে নিজের স্বার্থের অনুকূলে কাজ করে যায় তা হলে পৃথিবীতে যা আছে তার তুলনায় স্বর্গরাজ্য হয়ে যেত। আমি এও বলতে চাইনি যে মানুষের নিজের স্বার্থের কাজ করার চেয়ে কাজের আর কোনও মহত্ত্বর উদ্দেশ্য নেই। কিন্তু আমি মনে করি অজ্ঞাতভাবে কাজ করার চেয়ে জ্ঞাতভাবে নিজের স্বার্থের অনুকূলে কাজ করা পরার্থপরতার মতো মহত্তর। এ সুশৃঙ্খল সমাজে অন্যের স্বার্থে আপত্তি করার মতো এমন কাজ করবে কদাচিত খুব কম লোককে দেখা যায়। একজন কম বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ, অন্যের পক্ষে যা ক্ষতিকর, তা তারও ক্ষতির কারণ একথা মনে করতে পারেনা, কারণ ঘৃণা এবং প্রতিহিংসা তাকে অন্ধ করে রাখে।
যদিও আমি জ্ঞাতভাবে কাজ করাকে সর্বোচ্চ নৈতিকতা বলার ধৃষ্টতা পোষণ করি না, তবু মানুষ যদি জ্ঞাতভাবে নিজের স্বার্থের অনুকূলে কাজ করে পৃথিবীটা যা আছে তার চেয়ে অনেকগুণে ভালো হয়ে যাবে।
এ মুহূর্তে যেটা তীব্রভাবে অনুভব করছি সেটা নয়, একসঙ্গে সমস্ত প্রয়োজনীয় আকাক্ষার প্রতি দৃষ্টি রাখাকেই ফলিত বিচারবুদ্ধির সংজ্ঞা বলা যেতে পারে। বিচারবুদ্ধি অনেকটা আনুপাতিক মতামতের ওপর নির্ভর করে, এবং তা সম্পূর্ণ আয়ত্ব করা অসম্ভব। তাই বলে যখন কিছু মানুষকে পাগল বলি, তখন এটা পরিস্কার। যে কিছু সংখ্যককে অন্যান্য মানুষের চেয়ে অধিক বিচাররবুদ্ধিসম্পন্ন এ কথা বলে থাকি। আমি বিশ্বাস করি ভাষ্যগত এবং বাস্তব বিচারবুদ্ধির ফলেই পৃথিবীর প্রকৃত উন্নতি হয়েছে। পরার্থপরতার নীতি প্রচার করা আমার কাছে অর্থহীন, কারণ তা একমাত্র তাদের কাছে সক্রিয় যারা পরার্থপরতাকে জীবনের নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু বিচারবুদ্ধি সম্পর্কে প্রচার করার অর্থ ভিন্নতর, কেননা বিচারবুদ্ধির সাহায্যে আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, তা যাই হোক না কেন, বাস্তবে রূপায়ণ করতে সক্ষম হয়ে থাকি। একে অন্যের ক্ষতি করার বিভিন্ন পদ্ধতি যখন বিজ্ঞান আবিস্কার। করেছে তখন আমি বিশ্বাস করি, শিক্ষাব্যবস্থা, সংবাদপত্র, ধর্ম এক কথায় পৃথিবীর প্রধান শক্তিগুলো বিচার বুদ্ধির বিরুদ্ধে। ওসব শক্তিগুলো এমন লোকের কর্তৃত্বাধীনে যা ধর্মরাজ ডেমোগোকেও ভুলিয়ে পথ ভ্রষ্ট করে। বীরত্বের হুংকারে নয়, আত্মীয় প্রতিবেশী এবং পৃথিবীর প্রতি ব্যক্তির সুস্থ এবং নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের মধ্যেই নিহিত এর প্রতিবিধান। একমাত্র ব্যাপক বিস্তৃতিশীল বুদ্ধির কাছেই আমাদের পৃথিবী যে দূর্ভোগে ভুগছে তার নিরসন কামনা করব।
০৫. বিংশ শতাব্দীর দর্শন
মধ্যযুগের শেষ দিক থেকে রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রাধান্যের মধ্যে দর্শনের অবলুপ্তি ঘটে। ওকহামের উইলিয়াম ছিলেন মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠতম দার্শনিকদের একজন। তাঁকে কাইজার পোপের বিরুদ্ধে বিজ্ঞাপন লেখার জন্যে ভাড়া করেছিলেন। কারণ সে যুগের জ্বলন্ত সমস্যাসমূহের সঙ্গে সাম্প্রদায়িক বিরোধের প্রত্যক্ষ সম্বন্ধ ছিল।
সপ্তদশ শতাব্দীতে দর্শনের অগ্রগতির সঙ্গে ক্যাথলিক গির্জার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রামের সম্পর্ক ছিল, তবে তা কোথাও কম কোথাও বেশি। সত্যিকার অর্থে মেইল ব্রাঁসেও ছিলেন একজন পুরোত, কিন্তু পুরোতদেরকে তার দর্শন পড়তে দেয়া হতো না। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফরাসিদেশে লকের শিষ্যবর্গ এবং উনবিংশ শতাব্দীতে ইংল্যাণ্ডে বেনথাপন্থীরা ছিলেন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে সম্পূর্ণরূপে বামপন্থী এবং তাদেরই প্রভাবে আধুনিক বুর্জোয়া উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর প্রসার ঘটেছে। কিন্তু অগ্রগতির ব্যাপারে দর্শন এবং রাজনীতির মধ্যে পারস্পরিক সম্বন্ধের কোন সুনির্দিষ্ট রূপ আভাসিত হয়ে ওঠে নি। দর্শনের দিক দিয়ে যদিও হিউম ছিলেন বামপন্থী কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন একজন টোরি সমর্থক। একমাত্র রাশিয়াতেই প্রাক-বিপ্লব আমল পর্যন্ত মধ্যযুগীয় দর্শনের ভাঙাগড়া অথবা কোন রূপান্তর ঘটেনি। ফলে দর্শন এবং রাজনীতির যে-কোন সম্পর্ক দীর্ঘকাল ধরে আলাদা আলাদাভাবে অস্তিত্ব বজায় রাখতে পেরেছিল! বলশেভিকরা হলো বস্তুবাদী এবং সাদা মানুষেরা আদর্শবাদী। তিব্বতে এদুয়ের সম্পর্ক অতি নিবিড়, এমনকি দার্শনিক প্রধানকেই রাষ্ট্রের দ্বিতীয় ব্যক্তি বলে গণ্য করা হয়। তাছাড়া অন্য কোনও দেশে দর্শনকে এত সম্মান দেয়া হয় না।