.
অনেকে চিন্তা করেন, মনঃসমীক্ষা মানুষের মনের বিচিত্র ধারণা এবং উন্মত্ত বিশ্বাসের উৎপত্তির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে আমাদেরকে দেখিয়ে দেয় যে বিশ্বাসের ক্ষোত্রে বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন হওয়া অসম্ভব। মনঃসমীক্ষার প্রতি আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধাবোধ আছে এবং প্রভত উপকার করতে পারে বলেও আমি ধারণা পোষণ করি ফ্রয়েড এবং তার শিষ্যবর্গকে কিসে অনুপ্রাণিত করেছিল সে সম্পর্কে অনেকেই কোন ধারণা রাখে না। উন্মত্ত রোগের এই পদ্ধতি অনেকাংশে চিকিৎসা সম্বন্ধীয় হিস্টিরিয়া এবং অন্যান্য উন্মত্ত রোগের নিরাময়ের জন্য আবিস্কৃত। যুদ্ধকালীন সময়ে মনঃসমীক্ষা যুদ্ধের ভীতিসঞ্জাত নিউরোসিস রোগীদের আরোগ্যের ক্ষেত্রে অনেকগুণে বেশি ফলপ্রসু প্রমাণিত হয়েছে। রিভার্স-এর প্রকৃতি এবং অচেতন (Instinct and unconscious) বহুলাংশে বোমায় আহত রোগীদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ভয়ের ফলে রোগ উৎপত্তির একটা চমৎকার বিশ্লেষণ, যা সোজাসুজিভাবে দেখানো সম্ভবপর নয়। রোগীকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় অবশ ইত্যাদি করে মানসিক চিকিৎসা করা হয়; এজন্য অনেকে বুদ্ধিবৃত্তিসম্মত বলে স্বীকার করেন না। বর্তমান মুহূর্তে সে সবের সঙ্গে আমাদের কোন সংশ্রব নেই, এটা হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক বিচ্যুতি! প্রবৃত্তিগত বাধাই পাগলের মতিভ্রমের কারণ এবং তাতে খাঁটি মানসিক পদ্ধতিতে চিকিৎসা করে আরোগ্যও করে তোলা যায় এবং এই চিকিৎসার দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে পূর্বনির্ধারিত মতে এক জাতীয় আদর্শ সুস্থতার কল্পনাও করা হয়, যে অবস্থা থেকে রোগীর পরিস্থিতি ভিন্ন পথে ধাবিত হয়েছে, তাকে এই পরিবর্তনের সমকালীণ সব ঘটনা সে ভুলে যেতে চায় তাও অবগত করিয়ে পূর্বের সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়। যারা মাঝে মাঝে ভুল করে অথবা সংক্ষিপ্ত করার জন্য নির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি আখ্যা দিয়ে বিচারবুদ্ধিবিরুদ্ধ বিশ্বাসের প্রচলন দেখাবার অলস অভিযোগ করে থাকেন, মনঃসমীক্ষণ ঠিক তার বিপরীত। এর সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত সাদৃশ্যাত্মক পদ্ধতিতে যারা বদ্ধপাগল নয়, তাদেরও চিকিৎসা করা যেতে পারে, যদি তারা তাদের পাগলামির লক্ষণের সঙ্গে পরিচিত নয় এমন চিকিৎসকের কাছে স্বেচ্ছায় আত্মনিয়োগ করে।
প্রেসিডেন্ট, কেবিনেট মন্ত্রীবৃন্দ এবং বিখ্যাত ব্যক্তিরা কোন চিকিৎসকের কাছে আত্মসমর্পণ করেন না বলে রোগমুক্তও হতে পারেন না।
.
এতক্ষণ পর্যন্ত আমরা বিচারবুদ্ধি ভাষ্যগত অর্থ নিয়ে পর্যালোচনা করেছি। এর বাস্তব দিকটি অধিকতর কষ্টসাপেক্ষ এবং সে দিকেই আমাদের দৃষ্টি ফেরাতে হবে। বাস্তব ক্ষেত্রে মতের বিভিন্নতা দ্বিতীয়তঃ আকাক্ষার বাস্তবায়নের উপায় পরিকল্পনার বিভিন্নতা। কিন্তু দ্বিতীয় প্রকারে বিভিন্নতা শুধুমাত্র থিয়োরিতে সীমাবদ্ধ এবং বুৎপত্তিগত অর্থে বাস্তব। উদাহরণস্বরূপ কোন কর্তৃপক্ষের মতে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রথম লাইন যুদ্ধ জাহাজ দিয়ে গঠিত হওয়া উচিত। এখানে যে প্রস্তাবিত লক্ষ্য জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে কোনও রকমের মতদ্বৈততা নেই, শুধু উপায় পরিকল্পনার বিভিন্নতার বিবাদ। যে পর্যন্ত বর্তমানে অথবা ভবিষ্যতে নিশ্চিত অথবা সম্ভাব্য ঘটনাবলীর ক্ষতি করার সম্ভাবনা থাকে, সে পর্যন্ত যুক্তিকে পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পরিচালনা করা যায়। এ সমস্ত ক্ষেত্রে বিচারবুদ্ধির সঙ্গে বাস্ত বের সংযোগ থাকা সত্ত্বেও আমি ভাষ্য অথবা থিয়োরিগত অর্থেই বিচারবুদ্ধিকে ব্যবহার করেছি।
সে যা হোক, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই পরিমণ্ডলে এমন কিছু আসবে যা জটিল কিন্তু ফলিত দিক দিয়ে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। একজন মানুষ যখন নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে কাজ করবার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে, তখন নিজেকে এই বিশ্বাসে অনুপ্রাণিত করে যে, তা করলে তার অভীষ্ট সিদ্ধি হবে, কিন্তু যখন তার কোনও লক্ষ্য থাকে না তখনও সে তার কাজের পেছনে যে বিশ্বাস তার মর্মমূল অনুসন্ধান করে দেখে না। বাস্তবে যা ঘটেছে এবং যা ঘটবার সম্ভাবনা রয়েছে সবকিছুকে সে তার চেয়ে ভিন্ন আকাঙ্খ পোষণকারী একজন যে ভাবে দেখে সে দেখে তার উল্টো। সকলেরই জানা কথা জুয়াড়িরা সবসময় বিচারবুদ্ধিরহিত বিশ্বাসে নির্ভর করে, সব সময় আশা পোষণ করে যে তারা জয়ী হবেই। রাষ্ট্রনীতিতে অংশগ্রহণকারী লোকদের স্থির ধারণা তাদের দলের নেতৃবৃন্দ বিপক্ষদলের নেতাদের এত কখন দুর্নীতি কলা-কৌশল অবলম্বন করে না। শাসকশ্রেনী বিশ্বাস করে জনগণের কল্যাণের জন্য তাদের সঙ্গে ভেড়ার পালের মতো ব্যাবহার করা উচিৎ! ধূমপায়ীরা ধূমপানের স্বপক্ষে যুক্তি প্রদান করে বলে, ধূমপানের ফলে স্নায়ুতে স্নিগ্ধতা আসে। মদ্যপায়ীদের মতে মদ রসবোধক সঞ্জীবিত করে। এ সকল কারণে সৃষ্ট একঘেঁয়েমীর ফলে ঘটনা সম্বন্ধে মানুষের মতামত মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়ে পড়ে, যা এড়িয়ে যাওয়া খুবই কঠিন।
স্নায়ুতন্ত্রের প্রক্রিয়া সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিকদের জ্ঞানগর্ব আলোচনাতেও অনেক অন্তঃস্থ প্রমাণপঞ্জীর অনেককিছু বাদ পড়ে যায়। লেখক মদ্যপায়ী অথবা মদ্য অভ্যাসের যৌক্তিকতা প্রমাণ করবেন। ধর্ম এবং রাজনীতির ক্ষেত্রেও এ জাতীয় মনোভাব অপরিহার্য। রাষ্ট্রনীতিতে যারা অংশ নেন তারা ভাবেন জনগণের কল্যাণের আকাঙ্খই তাদেরকে মতবাদ স্থির করতে অনুপ্রাণিত করেছে। কিন্তু দশবারের মধ্যে নয় বার বলে দেয়া যায় যে একজন মানুষের রাষ্ট্রনীতিতে অংশগ্রহণ তার বাস্তব জীবনধারা থেকে উদ্ভূত। এর ফলে কিছু সংখ্যক মানুষ মনে করে এবং কিছুসংখ্যক মানুষ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে এসব ব্যাপারে বস্তুনিরপেক্ষ হওয়া অসম্ভব এবং পক্ষপাতমূলক শ্রেণীসমূহের মধ্যে টাগ অব ওয়ার ছাড়া এর কোন সমাধান নেই।