মতামতের খাতিরে বলতে হলে বিচারবুদ্ধির সজ্ঞায়ন করার ব্যাপারে সত্যে উপনীত হওয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় প্রমাণপঞ্জীর সাহায্য গ্রহণ করা উচিত। যেখানে নিশ্চিত করে কিছু বলা সম্ভব নয়, সেখানে একজন বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ সর্বাধিক সম্ভাব্য মতামতের উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব প্রদান করেন এবং কম সম্ভাবনাসম্পন্ন মতামতগুলোকে মনে মনে রেখে দেন, উপযুক্ত প্রমাণের সাহায্যে সেগুলোও সম্ভাবনাময় হয়ে উঠতে পারে। বস্তুনিরপেক্ষ পদ্ধতিতে ঘটনার এবং ঘটনার সম্ভাব্যতা নির্ধারণ করা হয়। বস্তুনিরপেক্ষ পদ্ধতি অনুসারে দুজন মানুষ সতর্কভাবে এগুলো একই সিদ্ধান্তে আসতে পারে; কিন্তু অনেক সময় তাতে সন্দেহ পোষণ করা হয়। অনেকের মতে ব্যক্তির আকাঙ্ক্ষা এবং প্রয়োজনের সন্তুষ্টি বিধানই হলো বুদ্ধিবৃত্তির একমাত্র কাজ। ‘দ্যা প্লেবস টেক্সটবুক কমিটি, তাদের দর্শনের সীমারেখা গ্রন্থে বলেনঃ ‘সর্বোপরি বুদ্ধিবৃত্তি হলো একটি পক্ষপাতমূলক অস্ত্রবিশেষ (পৃষ্ঠা ৬৮) এর কর্ম হলো কোন ব্যক্তি অথবা শ্ৰেণীবিশেষের পক্ষে উপকারী কাজগুলোর সম্পাদন এবং অনুপকারী কাজগুলো বর্জন করা।
কিন্তু একই গ্রন্থকার একই গ্রন্থে আবার বলেছেন মার্কসবাদীদের বিশ্বাস ধর্মীয় বিশ্বাসের চেয়ে ভিন্নতর ধর্মীয় বিশ্বাস, কামনা এবং ঐতিহ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। পক্ষান্তরে মার্কসীয় বিশ্বাসে নৈর্ব্যক্তিক বস্তুবাদের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের উপর প্রতিষ্ঠিত। মার্কসীয় মতবাদ গ্রহণে বুদ্ধিবৃত্তি যদি তাদেরকে পরিচালনা না করে থাকে, তা হলে বুদ্ধিবৃত্তিসম্বন্ধে তাদের মতবাদ সামঞ্জস্যহীন। যে ভাবেই হোক, যখন তারা নৈর্ব্যক্তিক বস্তুবাদের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণকে গ্রহণ করেছেন, নৈর্ব্যক্তিক বস্তুবাদের বিচারবুদ্ধিসম্মত মতবাদকেও তারা অবশ্যই গ্রহণ করবেন।
.
প্রয়োগবাদী ও দার্শনিকদের মতো অনেক পণ্ডিত গ্রন্থকারও রয়েছেন যারা বিচারবুদ্ধিবিরুদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গিকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। তাদেরকে চেনাও খুব সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। তারা বলে থাকেন যে, সত্য হলেও আমাদের মতামতের সঙ্গে সঠিকভাবে মিলে যাওয়ার মতো কোন বস্তুবাদী সত্যের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামের অস্ত্র হিসাবে অভিহিত করবেন। এর মধ্যে যেগুলো মানুষকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে সেগুলোকেই বলা হয় সত্য। খ্রিস্টিয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে ধর্ম যখন সর্বপ্রথম জাপানে এসে পৌঁছে তখন জাপানে এই মতবাদ প্রচলিত ছিল। সরকার নতুন ধর্ম গ্রহণের আদেশ দিলেন। তিনি যদি অন্যান্যের চেয়ে অধিকতর উন্নতি করেন তাহলে সর্বজনীনভাবে নতুন ধর্ম গ্রহণ করা হবে। তারা এই মতবাদ অনুসারে (আধুনিক যুগে খাপ খাওয়ার মতো পরিবর্তন সাধন করে। বিভিন্ন ধর্মীয় মতবাদের বিভিন্নতা স্বীকার করে নিয়ে থাকেন কিন্তু তবু তাদের কাউকে অন্যান্য ধর্মের চাইতে দ্রুত উন্নতি বিধান করতে সক্ষম ইহুদী ধর্ম গ্রহণ করতে আমি এ পর্যন্ত শুনি নি।
প্রয়োগবাদীদের সত্যের সংজ্ঞা যাই হোক না কেন সব সময় তারা নিতান্ত সাধারণ জীবনযাপন করে থাকেন। এমন কি বাস্তবে যতটুকু প্রয়োজন তারও চেয়ে ভয়াবহ দারিদ্রের মধ্যে দিয়ে তারা জীবন অতিবাহিত করে থাকেন। একজন প্রয়োগবাদীকেও যদি জুরিতে বসিয়ে দেয়া হয়, তিনিও অন্যান্যদের মতো প্রমাণের ওপর গুরুত্ব প্রদান করে খুনের মামলার তদন্ত করবেন। কিন্তু তার প্রচারিত মতবাদ অনুসারে বিচার করতে হলে তাকে ভেবে দেখতে হবে। জনসমষ্টির মধ্যে কাকে ফাঁসিতে লটকানো লাভজনক হবে। তার সংজ্ঞা অনুসারে জ্ঞানের আসামীর অপরাধ অন্যান্যের তুলনায় অধিকতর সত্য। এ ধরনের প্রয়োগবাদ মাঝে মাঝে ঘটে থাকে বলে আমার ভয় হয়। আমি রাশিয়া এবং আমেরিকার ফ্রেম আপ’ (frame up) এর বর্ণনা শুনেছি যা এ ধরনের বহু ভয়ের বর্ণনা দিয়েছে। এসব ব্যাপারে গোপন করবার সকল সম্ভাব্য প্রচেষ্টা করা হয় এবং তাতে বিফল হলে বিষময় ফল ফলে। এই জাতীয় গোপন করার পদ্ধতি থেকে প্রমাণিত হয় যে ফৌজদারি মামলা পরিচালনা করার সময় পুলিশও এক জাতীয় বস্তুবাদী সত্য মেনে চলে। বিজ্ঞানে যাকে সেকেলে এবং পায়ে হাঁটা বলে। এটাও সে ধরনের বস্তুবাদী সত্য ধর্মের মধ্যে যা এতদিন সমাধান অনুসন্ধান করে আসছে। তারপর মানুষ, ধর্ম ঝজুভাবে সত্য এ বিশ্বাস পরিত্যাগ করে অন্য কোন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে এর সত্যতা প্রমাণ করতে আত্ননিয়োগ করল। প্রমাণহীন কিছুর প্রতি বিশ্বাস এবং পর্যাপ্ত প্রমাণ যুক্ত কিছুকে অবিশ্বাস করা থেকে বস্তুবাদী সত্যের প্রতি অবিশ্বাসের উৎপত্তি, এটা খুব স্পষ্টভাবে দেখান যায়। নিরপেক্ষ বস্তুবাদে বিশ্বাস সবসময় চাকর নিয়োগ করার এত বিশেষ বিশেষ প্রশ্নের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করে থাকে। যদি ঘটনা অনুসারে আমাদের বিশ্বাস কোথাও সত্য প্রমাণিত হয়, তা হলে অজ্ঞেয়বাদ অনুসারে সর্বত্রই তা পরীক্ষা করা যেতে পারে।
উপরোক্ত আলোচনা আমাদের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু অনুসারে খুবই অপর্যাপ্ত, তাতে সন্দেহ নেই। নিরপেক্ষ বস্তুবাদকে দার্শনিকেরা খুবই ঘুরালো প্যাঁচালো করে ফেলেছেন। সে জন্য আমি স্থানান্তরে খুবই সহজভাবে বিশ্লেষণ করতে চেষ্টা করেছি। এক্ষণে আমি ধরে নেব কতকগুলো ঘটনার সম্ভাব্যতা সম্পর্কে ধারণা করা যায়। আমাদের বিশ্বাস অনেক সময় আসল সত্যের বিপরীত, এমনকি যখন আমরা প্রমাণের সাহায্যে কোনকিছুর সম্ভাব্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত ধারনা পোষণ করি, একই প্রমাণে তা অসম্ভবও প্রমাণিত হতে পারে। আমাদের বিশ্বাসসমূহ আমাদের কুসংস্কার, আকাঙ্খ এবং ঐতিহ্যের উপর স্থাপন করা উচিত নয়। কারণ বিশ্বাসসমূহের মধ্যেই বিচার-বুদ্ধির ভাষ্যগত অংশ নিহিত। বিষয়বস্তু অনুসারের একজন বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে হয়ত একজন বিচারক অথবা একজন বৈজ্ঞানিকের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন হতে হবে।