আমি শুধু একটা বিষয়কে নিচ্ছি, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সকলেই জানেন, বের্গসঁন মনে করতেন স্মৃতিতে অতীত জীবিত থাকে এবং মনে করতেন আদতে মানুষ কিছুই ভুলতে পারে না। এ সকল দিকে তার সঙ্গে ড. হোয়াইটহেডের মতের মিল রয়েছে। এ হলো কাব্যের জন্য খুবই সুন্দর কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে তার সাহায্যে যথাযথ বাস্তব কিছু নির্দেশ করা যায় না (অন্তত আমার তাই-ই চিন্তা করা উচিত)। আদি যদি অতীত কোন ঘটনাকে স্মরণ করি, উদাহরণস্বরূপ যেমন আবার চীনে আগমন, তাহলে তা শুধু কথার কাঠামো যে আমি আবার চীনে আগমন করছি। যখন আমি স্মরণ করি তখন কিছু সংখ্যক শব্দ বা প্রতাঁকের প্রয়োজন হয়। কার্যকারণ সূত্র এবং যৌক্তিক সমতার চাইতে কিছু বেশি অংশে কী স্মরণ করছি তার সঙ্গে সম্পর্কশীল। স্মৃতিকে যদি আমরা অতীত ঘটনার অনুরণন বলতে চেষ্টা করি, তাহলেও কিন্তু অতীত ঘটনা স্মরণ করবার বৈজ্ঞানিক সম্বন্ধ অটুট থেকে যায়। যদি আমরা তা বলি তা হলেও স্বীকার করে নিতে বাধ্য হব সময়ের ব্যবধানে ঘটনাটির পরিবর্তন হয়েছে এবং এ পরিবর্তন কেননা হয় তার কারণ আবিষ্কার করতে গিয়ে বৈজ্ঞানিক সমস্যার সম্মুখীন হব। আমরা স্মৃতিতে নতুন ঘটনা অথবা বহুলাংশে পরিবর্তিত পুরনো ঘটনা বললেও তাতে বৈজ্ঞানিক সমস্যাটির কিছুই হয় না।
হিউমের সময় পর্যন্ত বিজ্ঞানের দর্শনের প্রধানতম আপবাদ ছিল কার্যকারণ এবং আরোহ পদ্ধতি। আমরা সকলেই দুটোতেই বিশ্বাস করি। কিন্তু হিউম দেখিয়ে দিলেন যে আমাদের বিশ্বাসসমূহে অন্ধতার কোন যৌক্তিক ভিত্তি নেই। ডঃ হোয়াইটহেড বিশ্বাস করেন তার দর্শন হিউম দর্শনের একটি জবাববিশেষ। কান্টও তাই করেছেন। আমি নিজে কিন্তু এ দু-উত্তরের কোনটাকেই গ্রহণ করতে পারিনে। তা সত্ত্বেও অন্যান্য মানুষের সঙ্গে মত মিলিয়ে বিশ্বাস করতে বাধ্য হই যে অবশ্যই একটা উত্তর থাকতে হবে। এ জাতীয় ক্রিয়াকলাপ মোটেই সন্তোষজনক নয়, বিজ্ঞানের মতো দর্শনের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে। আমাদেরকে অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে যে একটা জবাব পাওয়া যাবে, কিন্তু সে জবাব পাওয়া গেছে একথা মানতে আমি মোটেই রাজি নই।
বর্তমানের বিজ্ঞানের কিছু অংশ আমাদের প্রিয় এবং কিছু অংশ প্রিয় নয়। পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি দান করে বলে প্রায় বুদ্ধিবৃত্তিক সন্তষ্টি দান করতে পারে বলে খুবই অল্প সংখ্যক মানুষের কাছে তা গ্রহণীয় হয়ে থাকে। তা অপ্রিয়, এ কারণে যে, যতই আমরা সত্যকে ঢেকে রাখতে চেষ্টা করি না কেন, থিয়োরি গতভাবে মানুষের কাজকে পূর্বাহ্নে নির্ধারিত করার শক্তিতে বিশ্বাস করে থাকে এবং এ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে তা মানুষের শক্তির স্বল্পতা সাধন করেছে। সভাবতঃই মানুষ বিজ্ঞানের অপ্রিয় দিকটিকে বাদ দিয়ে প্রিয় দিকটিকে গ্রহণ করতে চায়। সে জন্যে এ পর্যন্ত যতরকমের চেষ্টা করা হয়েছে তার প্রত্যেকটিই বিফলমনোরথ হয়েছে। যদি আমরা এ সত্যের উপর জোর দেই যে আরোহ এবং কার্যকারণ পদ্ধতির উপর আমাদের যে বিশ্বাস তা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, তাহলে আমাদের অনুমান করতে হয় যে আমরা-বিজ্ঞানকে সত্য বলে মানি না এবং যে কারণে বিজ্ঞান আমাদের কাছে প্রিয় যে কোন মুহূর্তে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি এর পরিবর্তে যে মতবাদ এখন সম্পূর্ণভাবে থিয়োরিগত আধুনিক মানুষ তা এখন বাস্তবে প্রয়োগ করতে পারে না। পক্ষান্তরে যদি আমরা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির দাবিকে মেনে নেই তাহলে আমরা এ উপসংহার কিছুতেই এড়াতে পারব না যে আরোহ এবং কার্যকারণ পদ্ধতিকে অন্যান্য সবকিছুর মতো মানুষের সংকল্পেও প্রয়োগ করা যায়। বিংশশতাব্দীর পদার্থ, শারীরবিদ্যা এবং মনস্তত্ত্ব যা কিছু ঘটেছে সবকিছু একসঙ্গে এই উপসংহারকে বলবৎ করেছে। এর ফলাফল সম্ভবত এ দাঁড়াতে পারে যে, যদিও বিজ্ঞানের যুক্তিসম্মত মূল্যায়নের থিয়োরি অপর্যাপ্ত, তবু বিজ্ঞানে এমন কোন পদ্ধতি নেই যাতে করে বিজ্ঞানের অপ্রিয় দিকটি বাদ দিয়ে প্রিয় দিকটি গ্রহণ করা যায়। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যে যুক্তি তা দিয়ে হয়ত আমরা তা করতে পারি, কিন্তু তা করলে বিজ্ঞানের উৎসমূলকে আমরা শুকিয়ে ফেলব অথচ তাই হলো পৃথিবীকে বুঝবার একমাত্র আকাঙ্ক্ষা’ ভবিষ্যতে এ জটিল সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান পাওয়া যাবে এটা আশা করা যায়।
০৪. মানুষ কি বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন হতে পারে?
আমি নিজেকে একজন বিচার বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে ভাবতে অভ্যস্ত এবং আমি চাই সব মানুষই বিচার বুদ্ধির অধিকারী হোক। বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন সকল ব্যক্তিই স্বভাবতঃ এরূপ কামনা করবেন। এ যুগে বিচারবুদ্ধি নানাভাবে মার খেয়েছে বলে এর স্বরূপ জানতে পারলেও মানব-সাধারণ তা আয়ত্ব করতে পারে কিনা? বিচারবুদ্ধির দুটো দিক; ভাগ্যগত এবং বাস্তব। কিন্তু বিচারবুদ্ধিসম্মত মতামত এবং আচরণ বলতে কী বোঝায়? প্রয়োগবাদ (Pragmatisom) মতামতের অযৌক্তিকতার ওপর প্রাধান্য দিয়ে থাকে উভয়দিকের অনেকে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। মতামত এবং আচরণকে একসঙ্গে ধরে রাখার এত আদর্শ বিচারবুদ্ধির কোন মাপকাঠি নেই। ধরুন আমি আর আপনি দুজন যদি দু মতের সমর্থনে ঝগড়া করতে থাকি তাহলে যুক্তি অথবা তৃতীয় ব্যক্তির সালিশীর মাধ্যমে সমাধান করার কথা অর্থহীন, গলাবাজি বিজ্ঞাপন এমনকি আমাদের অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তি অনুসারে শেষপর্যন্ত যুদ্ধের মাধ্যমে নির্ধারণ করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। আমার মতে এ-ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি খুবই ক্ষতিকর এবং শেষপর্যন্ত সভ্যতার পক্ষে মারাত্মক হয়ে দাঁড়াবে। সুতরাং আমি দেখাতে চেষ্টা করব, যে সব ধারণাকে বিচারবুদ্ধিবিরুদ্ধ বলে গণ্য করা হতো, তাও বিচারবুদ্ধিকে খর্ব করতে পারে না, পূর্বের মতো জীবন এবং চিন্তার একমাত্র পথনির্দেশক হিসেবে বিচারবুদ্ধিই থাকে ক্রিয়াশীল।