কিন্তু তার একটি অসুবিধা আছে, তাহলো অপ্রতিরোধ্য এবং কর্কশ সত্যের প্রতি স্পৃহা, যার প্রয়োজন একইভাবে অপরিহার্য, মধ্যযুগে তা অনুপস্থিত ছিল এবং প্রাচীনকালে তা সাধারণত দৃষ্টিগোচর হতো না। রেনেসাঁর আগে বস্তুর প্রতি অনুসন্ধিৎসা ব্যক্তিবিশেষের মধ্যে দেখা যেত। উদাহরণস্বরূপ সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রেডারিক এবং রোজার বেকনের নাম করা যেতে পারে। কিন্তু রেনেসাঁর সময়ে তা বুদ্ধিমান লোকদের মধ্যে পরিব্যাপ্ত হয়ে পড়ে। প্রাকৃতিক আইনের প্রতি অনাসক্ত মতের লেখার মধ্যেও তা দেখা যায়; অথচ মতে বিজ্ঞানের মানুষ ছিলেন না। সাধারণ অথবা বিশেষ আকর্ষণের আশ্চর্য রসায়ন ঘটেছিল বিজ্ঞানের ব্যাপারে। বিশেষ বিশেষ বিষয় এই আশায় পড়া হতো যে তার ফলে সাধারণ বিষয়সমূহের উপর আলোকসম্পাত করা যাবে। মধ্যযুগে এটা ভাবা হতো যে সাধারণ নীতি মেনে বিশেষ সিদ্ধান্তে আসা যায়। রেনেসাঁর সময়ে তা প্রবল সমালোচনার সম্মুখীন হলো। ঐতিহাসিক পুরাতত্ত্ব সম্পর্কে আগ্রহ তাদেরকে বিশেষ বিশেষ ঘটনার প্রতি প্রবল আগ্রহী করে তোলে। মনের এই স্পৃহা যা গ্রিক রোমান এবং ঐতিহ্যাশ্রয়ী জ্ঞানের মাধ্যমে শিক্ষিত এবং সঞ্জীবিত হয়ে উঠেছিল, যা গ্যালিলিও কেপলারের অভ্যুত্থানকে সম্ভবপর করে তুলেছিল! স্বভাবতঃই এই আবহাওয়ার কিছুটা তাদের কাজকে বেষ্টন করেছিল এবং তা তাদের আজকের দিনের উত্তরাধিকারীর মধ্যে চলে এসেছে। বিজ্ঞান কখনও পরবর্তী রেনেসাযুগের ঐতিহাসিক বিদ্রোহ যা বিজ্ঞানের উৎসমূল তাতে নাড়া দেয় নি। প্রধানতঃ তা ছিল অবিবেচনাপ্রসূত একটি আন্দোলন এবং যা জনসাধারণের প্রচলিত বিশ্বাসেরই উপর ছিল প্রতিষ্ঠিত এবং যে অনুমানের অভাব ছিল, তাতে আর অভাব মিটান হলো অঙ্কবিদ্যা হতে ধার করে। এ অনুমান ছিল অবরোহপদ্ধতি অনুসারে গ্রিক হেতুবাদের প্রচলিত অপভ্রংশ। বিজ্ঞান দর্শনের সম্পর্ক অস্বীকার করল। অন্য অর্থে বলতে গেলে এর বিশ্বাসকে যাচিয়ে দেখা অথবা অর্থ ব্যাখ্যা করার এত যত্ন নেয় নি, হিউমের দ্বারা বর্জিত হয়েও আড়ালে অগোচরে রয়ে গেল।
শৈশবে যে যে কুসংস্কারের ক্রোড়ে লালিত হয়েছে তা থেকে বিচ্ছিন্ন করলে বিজ্ঞান টিকে থাকতে পারবে কিনা? অবশ্য দর্শনের প্রতি বিজ্ঞানের নিস্পৃহতার কারণ হচ্ছে বিজ্ঞানের অত্যাধিক সাফল্য, তা মানবশক্তির ধারণাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝে গোড়া ধর্মমতের সঙ্গে সংঘাত ছাড়া প্রায় সর্বাংশে মানুষের কাছে গ্রহণীয় হয়ে উঠেছে। তাহলেও হালে বিজ্ঞান নিজের সমস্যার গরজেই দর্শনের প্রতি আগ্রহশীল হয়ে পড়েছে, যা থিয়োরি অব রিলেটিভিটির মধ্যে সত্য হিসেবে দেখা দিয়েছে; বিশেষভাবে যার ফলে স্থান এবং কালকে স্থান-কাল একক সত্তা বলে স্বীকার করা হয়েছে। গতির বিচ্ছিন্নতার আপাতঃ প্রয়োজনীয়তার মধ্যে কোয়ান্টামতত্ত্বেও তা সত্য বলে স্বীকার করা হয়েছে। অন্যদিকে শারীরবিদ্যা এবং জৈব রসায়নবিদ্যা মনস্তত্ত্বের শিকড় প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে দর্শনেরও ভয়ঙ্কর ভীতির কারণ হয়ে পড়েছে। ড. ওয়াটসনের ব্যবহারবাদ হলো তার মধ্যে সবচেয়ে তীক্ষ্ণতম, তাতে দর্শনের ঐতিহ্যের প্রতি শুধু অসম্মান দেখান হয় নি। পক্ষান্তরে ব্যবহারবিদ নিজস্ব একটি নতুন দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত। এ সকল কারণে বিজ্ঞান ও দর্শন দীর্ঘকাল ধরে সশস্ত্র নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারবে না। তাদেরকে পরস্পরের বন্ধু অথবা শত্রু দু’টোর একটা হতেই হবে। বিজ্ঞান যতদিন দর্শনের বক্তব্যের মধ্যে যে-সকল প্রশ্ন তুলে ধরবে, পাশ না করা পর্যন্ত একে অপরের পরিপূরক অথবা বন্ধু হতে না পারলে, একে অপরকে অবশ্যই ধ্বংস করবে; কিন্তু একা একটি যে প্রভুত্ব করবে তারও কোন সম্ভাবনা নেই।
ড. হোয়াইটহেড বিজ্ঞনের দার্শনিক বিচারের জন্য দু’টি বিষয়ের অবতারণা করেছেন। একদিকে তিনি নতুন ধারণা দিয়েছেন, যার সাহায্যে রিলেটিভ বা আপেক্ষিক পদার্থবিদ্যা এবং কোয়ান্টামকে অতীতের নিরেট পদার্থবাদ দিয়ে গঠন করার চাইতে অধিকতর সন্তোষজনক বুদ্ধিগ্রাহ্য উপায়ে গঠন করবার পদ্ধতি বাতলে দিয়েছেন। তার কীর্তির এ অংশে যা আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম, সম্পূর্ণভাবে বিকশিত হয়ে উঠে নি, যদিও বিজ্ঞানের ব্যাপক ধারণার মধ্যে ভূণ হিসাবে তা রয়ে গেছে। সাধারণ পদ্ধতি সমূহের সাহায্যে যাচাই করা যায়, যা কিছু বস্তুর সঙ্গে অন্য বস্তুর সম্বন্ধের থিয়োরিগত বিশ্লেষণের দিকে আমাদের প্রচেষ্টাকে পরিচালিত করে। কারিগরি দিক দিয়ে দেখলে তা খুব জটিল এবং এ সম্পর্কে আর কিছু বলছি না। আমাদের বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে ড. হোয়াইটহেডের গ্রন্থের উল্লেখযোগ্য দিক হলো এর অতিদার্শনিক অংশ: তিনি শুধু উৎকৃষ্টতর বিজ্ঞানকে দেন নি, এমন একটি দর্শন দিয়েছেন যা বিজ্ঞানকেও যুক্তিসিদ্ধ করতে সক্ষম; কিন্তু তা এই অর্থে যে ঐতিহ্যিক বিজ্ঞান হিউমের পূর্বে কখনো যুক্তিনির্ভর ছিল না। তার দর্শন অধিকাংশ ক্ষেত্রে বের্গসঁনের দর্শনেরই সমগোত্রীয়। আমি নিজে অসুবিধা বলে যা মনে করছি তা হলো এ পর্যন্ত ড. হোয়াইটহেডের যে ধারণা তাকে ফর্মুলাবদ্ধ করে যে কোন সাধারণ বৈজ্ঞানিক বা যুক্তির পরীক্ষায় ফেলে যাচাই করা যায়, কিন্তু তার দর্শনের মধ্যে তার কোন উল্লেখ নেই। সুতরাং দর্শনের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যকে অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। বিজ্ঞান সত্যকে স্বীকার করে শুধু এ কারণে আমরা তা গ্রহণ করব না, এ কারণেও গ্রহণ করব যে তা বিজ্ঞানকেও যুক্তিসম্মত করে তোলে। প্রত্যক্ষভাবে আমাদের পরীক্ষা করে অবশ্যই জেনে নিতে হবে যা সত্য মনে হয় আদতে তার বাস্তব সমর্থন আছে কিনা এবং এখানেই আমরা পুরনো সকল রকমের হতবুদ্ধির শিকার হয়ে পড়ি।