সে যা হোক তারা এক মস্ত বিপদের সম্মুখীন হয়ে পড়েছেন। বিজ্ঞানের মানুষেরা এখন মুখ্যতঃ রক্ষণশীল হলেও বিজ্ঞান আজ পর্যন্ত পৃথিবীর দ্রুত পরিবর্তনের শ্রেষ্ঠতম মাধ্যম।
.
এ পরিবর্তনের ফলে আফ্রিকা, এশিয়া, ইউরোপের শিল্পাঞ্চলের মানুষের মনে যে আবেগের সঞ্চার করেছে তা অনেক সময় রক্ষণশীল মনোভাবাপন্ন মানুষদের অসন্তে ষের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং বিজ্ঞানের মূল্য সম্বন্ধে এক ধরনের গড়িমসি মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছে, যার ফলে পুরোত এবং ধর্মযাজকদের মধ্যে সংশয়বাদের উদয় হয়েছে। তা যদি একা হতো তা হলে তত বেশি প্রয়েজনীয় হতো না, কিন্তু প্রধান বুদ্ধিবৃত্তিক অসুবিধাগুলো এর সঙ্গে যুক্ত এবং তা যদি অনতিক্ৰমণীয় হয়ে দেখা দেয়। তাহলে বৈজ্ঞানিক আবিস্ক্রিয়ার উপর যবনিকাও টেনে দিতে পারে। একথার মানে আমি এ বলতে চাচ্ছি যে খুব শিগগিরই তেমন কিছু ঘটবে। প্রতীচ্য যে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে, এশিয়া এবং রাশিয়া আরো শতবছর হয়ত সে বৈজ্ঞানিক বিশ্বাসকে আঁকড়ে থাকতে পারে। শিগগির হোক অথবা দেরিতে হোক এ বিশ্বাস বর্জন করার বিরুদ্ধে যুক্তি প্রবল হয়ে দেখা দেবে এবং লোকসাধারণকে যে কোনভাবেই প্রভাবিত করবে; তার ফলে তারা ক্ষণিকের জন্য ক্লান্ত হয়ে পড়লেও পূর্বের সে আনন্দিত বিশ্বাসে ফিরে আসতে পারবে না। সুতরাং বিজ্ঞানের বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যুক্তিগুলো সযত্ন পরীক্ষার দাবি রাখে।
বৈজ্ঞানিক বিশ্বাসের নামে আমি এ কথা বলছি না যে তা শুধু যুক্তিগতভাবে প্রয়োগক্ষম, শুধু যে অর্থে বিজ্ঞান সত্য; কিন্তু আমি বলছি এমন কিছু যা অধিকতর উৎসাহব্যঞ্জক এবং কম যুক্তিনির্ভর। নাম করে বলতে গেলে সে সমস্ত আবেগ এবং বিশ্বাসের পদ্ধতি যা মানুষকে শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারক হতে অনুপ্রাণিত করে। এখন কথা হলো এ সমস্ত বিশ্বাস এবং আবেগ বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন মানুষের মধ্যে স্থায়ীভাবে বিরাজ করতে পারে কিনা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক মুক্তি ছাড়া কি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার অসম্ভব?
এ সমস্যার প্রকৃতি অনুধাবন করতে হলে সাম্প্রতিক দুটো চিত্তাকর্ষক বই আমাদেরকে প্রভূত সাহায্য করবে। বই দুটো হলো বার্ট এর ‘মেটাফিজিক্যাল ফাউণ্ডেশানস অব মডার্ন সায়েন্স’; প্রকাশকাল ১৯২৬ এবং হোয়াইটহেডের সায়েন্স অ্যাণ্ড দ্যা মডার্ন ওয়ার্ল্ড’; প্রকাশকাল ১৯২৬। এ দুটোর প্রত্যেকটাতেই আধুনিক পৃথিবী কোপার্নিকাস, কেপলার, গ্যালিলিও এবং নিউটনের কাছ থেকে যে ধারণা পদ্ধতি পেয়েছে তার সমালোচনা করেছে। প্রথমটা ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকেই লেখা হয়েছে। ড. হোয়াইটহেডের বইটিই অধিকতর দরকারি, কেননা তা শুধু সমালোচনা নয় ওতে গঠনমূলকও অনেক কিছু রয়েছে, ভবিষ্যতের বিজ্ঞানের জন্য বুদ্ধিবৃত্তিসম্মত ভিত্তি দেওয়ার চেষ্টাও তাতে করা হয়েছে। অধিকন্তু বইটাতে বিজ্ঞানবাদে মানুষের সাধারণ আশা-আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে আবেগদীপ্ত অনেক কিছুই রয়েছে। ড. হোয়াইটহেড তার থিয়োরির যে অংশকে আনন্দদায়ক আখ্যা দিয়ে যুক্তির অবতারণা করেছেন, আমি তা সমর্থন করতে পারি না। বৈজ্ঞানিক ধারণাক্রিয়ার বুদ্ধিবৃত্তিসঞ্জাত ধারণা গঠনের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে নিয়েও আমি মনে করি যে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির সঙ্গে সম্পর্কহীন আবেগ বিজ্ঞানের দিকে প্রবল টান ব্যতিরেকে পুরনো ধারণার মতো নতুন ধারণাকেও গ্রহণ করতে পারবে না এর সমর্থনে কি যুক্তি আছে, এখন আমরা তা তলিয়ে দেখছি।
.
ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গিয়ে, ড. হোয়াইটহেড নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক পদ্ধতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বস্তুপুঞ্জে সুসমঞ্জস সমাহারের প্রতি প্রবৃত্তিগত ব্যাপক বিশ্বাস ব্যতিরেকে জীবন্ত বিজ্ঞান বলতে কিছুই থাকতে পারে না। বিজ্ঞানের জন্ম দিয়েছেন একমাত্র তারাই যাদের এ বিশ্বাস ছিল। সুতরাং বিশ্বাসের মৌল উৎস প্রাক-বৈজ্ঞানিক। নিশ্চিতভাবে বিজ্ঞানের আবির্ভাবের জন্য যে মিশ্র মনোভাবের প্রয়োজন ছিল তাতে অন্যন্য উপাদানও মিশ্রিত হয়েছিল। তার মতে জীবন সম্বন্ধে গ্রিকদের ধারণা ছিল নাটকীয়, সূচনার চাইতে সমাপ্তিকেই জোর দেয়া হতো বেশি। বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে বিচার করতে গেলে এটাও একটা বিচ্যুতি। অন্যদিকে গ্রিক বিয়োগান্ত নাটকে নিয়তির ধারণা থেকে প্রত্যেকটা ঘটনার যে প্রাকৃতিক নিয়মের উপর নির্ভরশীল তার উদ্ভব হয়। গ্রিক নাটকের নিয়তির ধারণা আধুনিক চিন্তায় প্রাকৃতিক বিধান বলে রোমান সরকার (অন্ততঃ থিয়োরিগতভাবে হলেও) প্রাচ্যের স্বেচ্ছাচারী শাসকদের মতো খেয়ালখুশী মতো শাসনকার্য পরিচালনা করে নি, বরঞ্চ পূর্বনির্ধারিত আইনকানুন অনুসারেই তারা শাসন-শৃঙ্খলা পরিচালনা করেছে। অনুরূপভাবে খ্রিস্টধর্মও আইনানুসারে ভগবানের ধারণা করেছে যদিও সে আইনগুলো ভগবানেরই স্থিরীকৃত। এসবের ফলে প্রাকৃতিক আইনের সৃষ্টির পথ পরিষ্কার হয় এবং তা বৈজ্ঞানিক মনোভঙ্গীর একটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য।
যে সমস্ত অবৈজ্ঞানিক বিশ্বাস ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতাব্দীর অগ্রদূতদের অনুপ্রাণিত করেছিল, ড. বার্ট সেসব খুবই প্রশংসনীয়ভাবে অজ্ঞাত অনেক মৌলিক উৎসের সাহায্যে উপস্থাপন করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, কেপলারের অনুপ্রেরণার মূলে ছিল জরথুস্ত্রীয়দের সূর্য উপাসনা যা তিনি যৌবনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে বরণ করে নিয়েছিলেন। প্রাথমিকভাবে সূর্যকে দেবতা জ্ঞান করে ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করার পদ্ধতি হিসাবে গ্রহণ করতে অনুপ্রাণিত করেছিল। রেনেসাঁর যুগে খ্রিস্টিয় ধর্মবিশ্বাসের প্রতি বিরোধ প্রাথমিকভাবে প্রাচীন আদিমতার প্রশংসার মধ্যে যার অঙ্কুর নিহিত ছিল, সর্বত্রই পরিলক্ষিত হতো। নিয়মের মাধ্যমে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি খোলাসাভাবে, কিন্তু জ্যোতির্বিদ্যা ইত্যাদির যে পুণঃপ্রচলন হয়েছে, তার ফলে তা উদাহরণ হিসেবে নেয়া যেতে পারে। গির্জা শারীরিক নির্যাতন করে তার বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছিল। খ্রিস্টধর্মের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ তার সঙ্গে মিশেছিল কুসংস্কার যেমন বিজ্ঞানে কেপলারের ব্যাপারেও ছিল অঙ্গাঙ্গীভাবে কুসংস্কার বিজড়িত।