০১. মুখবন্ধ : সংশয়বাদের মূল্যনির্ধারণ প্রসঙ্গে
সংশয়ী রচনাবলী (অনুবাদ)
উৎসর্গ – অধ্যাপক কবীর চৌধুরী
[সংশয়ী রচনা – বাট্রাণ্ড রাসেলের স্কেপটিক্যাল প্রসেজ-এর বাংলা অনুবাদ। ১৯৯০ সালে বাংলা একাডেমী প্রথম সংস্করণ প্রকাশ করেছিলো। পরে বাংলাবাজারের প্যারীদাস রোডস্থ খান ব্রাদার্স এ্যান্ড কোম্পানি একটি নতুন সংস্করণ প্রকাশ করেছে।]
মুখবন্ধ : সংশয়বাদের মূল্যনির্ধারণ প্রসঙ্গে
আমি পাঠকদের সুবিবেচনার জন্য এমন একটি মত উপস্থিত করতে চাই যা তাদের কাছে উদ্ভট এবং ধ্বংসাত্মক মনে হবে বলে আমার আশঙ্কা হয়। কোন বক্তব্য অথবা যুক্তিকে সত্য বলে স্বীকার করার পর্যাপ্ত কারণ না থাকলে তা সত্য বলে কোন ক্ষেত্রে অনুমান না-করাই হলো আমার প্রস্তাবিত মতবাদ। আমি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করি যে এ রকম মতবাদ সাধারণ্যে গৃহীত হলে আমাদের সামাজিক জীবনধারা এবং রাজনৈতিক পদ্ধতি যে গুলোকে এখন নির্দোষ মনে করা হয়, তার মধ্য থেকে দোষ বের করে আমাদের রাষ্ট্রনৈতিক পদ্ধতি এবং সামাজিক জীবনধারার মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে। তা সম্ভব হলে ঝাঁঝালো বক্তা, বই ব্যবসায়ী, ধর্মযাজক এবং অন্যান্য যারা মানুষের অযৌক্তিক বিশ্বাসকে ভিত্তি করে বেঁচে থাকে, মানুষের ইহ-পরকালের সৌভাগ্যের জন্য কিছুই করে না, তাদের আয় যে সাংঘাতিকভাবে : কমে যাবে সে ব্যাপারেও আমি আত্মসচেতন (যা আরো বেশি বিপজ্জনক)। অনেক প্রতিকূল মারাত্মক যুক্তি থাকা সত্বেও আমি মনে করি, আমার অপ্রিয় মতবাদ সম্পর্কে বলবার মতো অনেক কিছু রয়েছে এবং বলতে আমি চেষ্টাও করবো।
প্রথমতঃ, আমি নিজেকে চূড়ান্তবাদী করে তোলার বিপক্ষে- আত্মসংযম বজায় রাখার ইচ্ছা পোষণ করি। আমি একজন বৃটিশ হুইগ, সেজন্য আমার মধ্যেও বৃটিশ আপোষমূলক এবং উদারনৈতিক মনোভাব বর্তমান। পিরহোনিজমের (pyrrohonsim) প্রবর্তক পিরহো সম্বন্ধে একটি গল্প প্রচলিত আছে। (পিরহোবাদ বা পিরহোনিজম হলো সংশয়বাদের পুরনো নাম।) এক ধরণের কর্মপন্থা যে অন্য ধরণের কর্মপন্থা অপেক্ষা নিশ্চিতভাবে বিজ্ঞোচিত একথা তিনি বিশ্বাস করতেন না। একদিন বিকেল বেলায় যখন তিনি তার প্রাত্যহিক ভ্রমণ সারছিলেন, দেখতে পেলেন তার দর্শনের অধ্যাপক একটি খানার মধ্যে পড়ে মাথাসমান ডুবে আছেন। (এই অধ্যাপকের কাছ থেকেই তিনি দর্শন শিখেছিলেন। কোনরকমেই বেরিয়ে আসতে পারছেন না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর চলে গেলেন। তিনি চিন্তা করলেন যে এই বুড়োকে টেনে তুলে তিনি যে ভালো কাজ করবেন তার কোন প্রমাণ নেই। যাঁরা কম সংশয়বাদী ছিলেন তারা তাকে উদ্ধার করে পিরহোর হৃদয়হীনতার নিন্দা করলেন। কিন্তু তার অধ্যাপক ছিলেন নীতিতে অটল বিশ্বাসী, তিনি পিরহোর নীতিনিষ্ঠার প্রশংসা করলেন। কিন্তু বর্তমানে আমি ততখানি বাহাদুরিপূর্ণ সংশয়বাদের ওকালতি করছি না। থিয়োরি হিসেবে না হলেও বাস্তবে আমি সাধারণজ্ঞানের সাধারণ বিশ্বাসরাজীর প্রতি সংশয়ের দৃষ্টি দিতে প্রস্তুত। আমি বিজ্ঞানের কোন প্রতিষ্ঠিত ফলাফলকে সত্য বলে না স্বীকার করে যুক্তিগত কর্মের অধিকতররা সম্ভাব্য ভিত্তি বলে মেনে নিতে প্রস্তুত। যদি বলা হয় অমূক তারিখে চন্দ্রগ্রহণ হবে আমার মনে হয় গ্রহণ হচ্ছে কি না দেখা অবশ্যই উচিত। পিরহো হলে অবশ্য অন্যরকম চিন্তা করতেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমি মধ্যমপন্থার কথা বলছি, একথা দাবি করা যুক্তিসঙ্গত বলে আমার ধারণা।
এমন অনেক ব্যাপার আছে, সে সব ব্যাপারে যারা পরীক্ষা করে দেখেছেন,তারা একমত হয়েছেন। দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্রহণের তারিখের কথা বলা যায়। এমনও অনেক বিষয় আছে, যে ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা একমত হতে পারেন না। আবার বিশেষজ্ঞরা একমত হলেও ভুল করতে পারেন। মধ্যাকর্ষণে আলোকের প্রতিসরণের যে গুরুত্ব আইনস্টাইন আবিস্কার করেছিলেন, বিশেষজ্ঞরা তার সঙ্গে বিশ বছর আগে একমত হন নি, কিন্তু তারপরেও তা সত্য প্রমাণিত হয়েছে। তা সত্বেও বিশেষজ্ঞরা যখন মতামতের ব্যাপারে একই মনোভাব পোষণ করেন, তখন বিরুদ্ধ কোন মতামতের চাইতে তাদের মতামতই সত্য হবে এটা আশা করা যায়। যে সংশয়বাদের পক্ষে আমি ওকালতি করতে চাই, তাহলো (১) যখন বিশেষজ্ঞরা একমত তখন বিরুদ্ধ মতামতকে নিশ্চিত বলে গ্রহণ করা হবে না। (২) যখন বিশেষজ্ঞরা একমত নন তখন অবিশেষজ্ঞের কোন মতামতকেই সত্য বলে গ্রহণ করবো না, এবং (৩) যখন নির্দিষ্ট কোন মত গ্রহণ করার পক্ষে প্রচুর যুক্তি থাকবে না তখন সাধারণ মানুষ কোন মতামত না দিলে ভালো করবে।
আপাতদৃষ্টিতে এ সকল প্রস্তাব খুবই নাজুক বলে মনে হতে পারে, কিন্তু তা সত্বেও যদি গ্রহণ করা হয়, তাহলে সামাজিক জীবনকে তা ব্যাপকভাবে বিপ্লবায়িত করবে।
যে সকল কারণে মানুষ যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক হয় এবং অত্যাচার করে, উপরোক্ত শ্রেণীর যে কোন এক শ্রেণীর অন্তর্গত-সংশয়বাদ তাদেরকে তীব্রভাবে সমালোচনা করে। কোন মতামতের যুক্তিগত ভিত্তি থাকলে পরে মানুষ সেগুলোকে তুলে ধরে সন্তুষ্ট থাকে এবং কাজে প্রয়োগ করা পর্যন্ত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে। এসব ক্ষেত্রে মানুষ মতামতের সঙ্গে আবেগকে জড়ায় না এবং শান্তভাবে মতামতকে তুলে ধরে এবং ধীরস্থিরভাবে পেছনের যুক্তির সাহায্যে বিশ্লেষণ করে। যে সকল মতামতের সঙ্গে আবেগের খুবই ঘনিষ্ট সম্পর্ক, সেগুলো সাধারণতঃ যুক্তির সুদৃঢ় ভিত্তির উপর সুপ্রতিষ্ঠিত নয় এবং আবেগের আধিক্যের সাহায্যেই যুক্তির অক্ষমতা প্রমাণ করা যায়।