- বইয়ের নামঃ কল্লোল যুগ
- লেখকের নামঃ অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
কল্লোল যুগ
০১. তার নাম সুবোধ দাশগুপ্ত
একই শ্লেটের দুপিঠে দুজনে একই জনের নাম লিখলাম।
তেরো শ আটাশ সালের কথা। গিয়েছিলাম মেয়েদের ইস্কুলহসটেলে একটি ছাত্রীর সঙ্গে দেখা করতে। দারোয়ানের কাছে গেট জিম্মা আছে, তাতে কাঙ্ক্ষিতদর্শনার নামের নিচে দর্শনাকাঙ্ক্ষীর নাম লিখে দিতে হবে। আরো একটি যুবক, আমারই সমবয়সী, এপার-ওধার ঘুরঘুর করছিল। শ্লেট নিয়ে আসতেই দুজনে কাছাকাছি এসে গেলাম। এত কাছাকাছি যে আমি যার নাম লিখি সেও তার নাম লেখে।
প্রতিদ্বন্দ্বী না হয়ে বন্ধু হয়ে গেলাম দুজনে। তার নাম সুবোধ দাশগুপ্ত। ডাক নাম, নানকু।
হৃদ্যতা এত প্রগাঢ় হয়ে উঠল যে দুজনেই বড় চুল রাখলাম ও নাম বদলে ফেললাম। আমি নীহারিকা, সে শেফালিকা।
তখন সাউথ সুবার্বন কলেজে-বর্তমানে আশুতোষ—আই-এ পড়ি। এন্তার কবিতা লিখি আর প্রবাসীতে পাঠাই। আর প্রতি খেপেই প্যারীমোহন সেনগুপ্ত (তখনকার প্রবাসীর সহ-সম্পাদক) নির্মমের মত তা প্রত্যর্পণ করেন। একে ডাক-খরচ। তায় গুরু-গঞ্জনা, জীবনে প্রায় ধিক্কার এসে গেল। তখন কলেজের এক ছোকরা পরামর্শ দিলে, মেয়ের নাম দিয়ে পাঠা, নির্ঘাৎ মনে ধরে যাবে। তুই যেখানে পুরো পৃষ্ঠা লিখে। পাশ করতে পারিস না, মেয়েরা সেখানে এক লাইন লিখেই ফার্স্ট ডিভিশন। দেখছিস ত—
ওই ঠিক করে দিলে, নীহারিকা। আর, এমন আশ্চর্য, একটি সদ্যফেরৎ-পাওয়া কবিতা নীহারিকা দেবী নামে প্রবাসীতে পাঠাতেই পত্রপাঠ মনোনীত হয়ে গেল।
দেখলাম, সুবোধেরও সেই দশা। বহু জায়গায় লেখা পাঠাচ্ছে, কোথাও জায়গা পাচ্ছে না। বললাম, নাম বদলাও। নীহারিকার সঙ্গে মিলিয়ে সে নাম রাখলে শেফালিকা। আর, সঙ্গে-সঙ্গে সেও হাতে-হাতে। ফল পেল।
লেখা ছাপা হল বটে, কিন্তু নাম কই? যেন নিজের ছেলেকে পরের বাড়িতে পোয় দিয়েছি। লোককে বিশ্বাস করানো শক্ত, এ আমার রচনা। গুরুজনের গুঞ্জনা গুরুতর হয়ে উঠল। কেননা আগে শুধু গঞ্জনাই ছিল, এখন সে সঙ্গে মিশল এসে গুঞ্জন। নীহারিকা কে?
অনেক কাগজ গায়ে পড়ে নীহারিকা দেবীকে কবিতা লেখবার জন্যে অনুরোধ করে পাঠাতে লাগল। নিমন্ত্রণ হল কয়েকটা সাহিত্যসভায়, দু-একজন গুণমোহিতেরও খবর পেলাম চিঠিতে। ব্যাপারটা বিশেষ স্বস্তিকর মনে হল না। ঠিক করলাম স্বনামেই ত্রাণ খুঁজতে হবে। স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ ইত্যাদি। অনেক ঠোকাঠুকির পর প্রবাসীতে ঢুকে পড়লাম স্বনামে, ভারতীও অনেক বাধা-বারণের পর দরজা খুলে দিল।
গেলাম সুবোধর কাছে। বললাম, পালাও। মাননীয় সাহিত্যিকার। নীহারিকা দেবীর সঙ্গে বাড়িতে দেখা করতে আসছেন। অন্তত নিজের ছদ্মনাম থেকে পালাও। আত্মরক্ষা করো। নইলে ঘরছাড়া হবে একদিন।
অর্ধশস্ফুট একটি বিশেষ হাসি আছে সুবোধের। সেই নির্লিপ্ত হাসি হেসে সুবোধ বললে, ঘরছাড়াই হচ্ছি সত্যি। পালাচ্ছি বাংলা দেশ থেকে।
কোন এক সমুদ্রগামী মালবাহী জাহাজে ওয়ারলেস-ওয়াচার হয়ে সুবোধ অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছে। পঞ্চাশ টাকা মাইনে। মুক্ত পাখির মতন খুশি। বললে, অফুরন্ত সমুদ্র আর অফুরন্ত সময়। ঠেসে গল্প লেখা যাবে। যখন ফিরব দেখা করতে এসে ডকে। অক্স-টাং খুব উপাদেয় জিনিস, খেয়ে দেখতে পারো ইচ্ছে করলে। আর এক-আধ দিন যদি রাত কাটাতে চাও, শুতে পাবে পালকের বালিশে।
সেই সুবোধ একদিন হঠাৎ মাদ্রাজ থেকে ঘুরে এসে আমাকে বললে, গোকুল নাগের সঙ্গে আলাপ করবে?
জানতাম কে, তবু ঝাজিয়ে উঠে জিগগেস করলাম, কে গোকুল নাগ? ওই লম্বা চুল-ওলা বেহালা-বাজিয়ের মত যার চেহারা?
অধস্ফুটশব্দে সুবোধ হাসল। পরে গম্ভীর হয়ে বললে, কল্লোলের সহ-সম্পাদক। তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চান। তোমার লেখা তাকে পড়াব বলে বলেছি। চমৎকার লোক।
ব্যাপার কি—কৌতূহলী হয়ে তাকালাম সুবোধের দিকে।
গোকুলের প্রতি, কেন জানি না, মনটা প্রসন্ন ছিল না। মাঝে-মাঝে দেখেছি তাকে ভবানীপুরের রাস্তায়, কখনো বা ট্রামে। কেমন যেন দূর ও দাম্ভিক মনে হত। মনে হত লম্বা চালের লোক, ধরাধানাকে যেন সরা জ্ঞান করছে। প্রবাসী ভারতীতে ছোট ধাঁচের প্রেমের গল্প। লিখত, যাতে অর্থের চাইতে ইঙ্গিত থাকত বেশি, যার মানে, দাঁড়ি-কমার চেয়ে ফুটকিই অধিকতর। সেই ফুটকি-চিহ্নিত হেঁয়ালির মতই মনে হত তাকে।
দুরের থেকে চোখের দেখা দেখে বা কখনো নেহাৎ কান-কথা শুনে এমনি মনগড়া সিদ্ধান্ত করে বসি আমরা। আর সে সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে এত নিঃসন্দেহ থাকি। সময় কোথায়, সুযোগই বা কোথায়, সে সিদ্ধান্ত যাচাই করি একদিন। যাকে কালো বলে জেনেছি সে চিরকাল কালো বলেই আঁকা থাক।
সুবোধ এমন একটা কথা বললে যা কোনো দিন শুনিনি বা শুনব বলে আশা করিনি বাংলা দেশে।
জাহাজে বসে এতদিন যত লিখেছে সুবোধ, তারই থেকে একটা গল্প বেছে নিয়ে কি খেয়ালে সে কল্লোলে পাঠিয়ে দিয়েছিল। আরো অনেক কাগজে সে পাঠিয়েছিল সেই সঙ্গে, হয় খবর এসেছে মনোনয়নের, নয় ফেরৎ এসেছে লেখা—সেটা এমন কোনো আশ্চর্যজনক কথা নয়। কিন্তু কল্লোলে কী হল? কল্লোল তার গল্প অমনোনীত করলে, সম্পাদকী লেপাফায় লেখা ফেরৎ গেল। কিন্তু সেই সঙ্গে গেল একটি পোস্ট কার্ড। যদি দয়া করে আমাদের অফিসে আসেন একদিন আলাপ করতে। তার মানে, লেখা অপছন্দ হয়েছে বটে, কিন্তু লেখক, তুমি অযোগ্য নও, তুমি অপরিত্যাজ্য। তুমি এসো। আমাদের বন্ধু হও।