- বইয়ের নামঃ পিশাচ দেবতা
- লেখকের নামঃ অনীশ দাস অপু
- সিরিজঃ সেবা হরর সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী বই
- বিভাগসমূহঃ ভূতের গল্প
পিশাচ দেবতা
পিশাচদেবতা
হেনরিকাস ভ্যানিং-এর সেদিনের অনুষ্ঠানে যাওয়া আমার মোটেই ঠিক হয়নি। ওর দাওয়াত যদি ফিরিয়ে দিতাম, খুব ভাল করতাম। তাহলে সেই রাতের ওই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার স্মৃতি আমাকে আর তাড়া করে ফিরত না। নিউ অরলিন্স ছেড়ে যাচ্ছি। বটে, চোখ বুজলেই ভেসে উঠছে ব্যাখ্যার অতীত ঘটনাগুলো। ইস্! কেন যে মরতে সেদিন রাস্তায় বেরিয়েছিলাম।
নিউ অরলিন্স এসেছিলাম লেখালেখির কিছু কাজ করতে। এক বহুলপঠিত পত্রিকার সম্পাদক খুব করে ধরেছিলেন মিশরীয় সভ্যতার ওপর কিছু গল্প লিখে দিতে। তিনি জানতেন রহস্যময় এই সভ্যতার প্রতি আমার নিজের অগ্রহও যথেষ্ট। বিশেষ করে মিশরীয় ধর্মের বিভিন্ন দেব-দেবী এবং প্রেতশাস্ত্রের ওপর আমার পড়াশোনা প্রচুর। সম্পাদকের অনুরোধ ফেলতে না পেরে সিদ্ধান নিলাম মিশরীয় দেবতাদের নিয়ে এবার অন্যরকম কিছু গল্প লিখব। একটু নিরিবিলির জন্য তাই নিউ অরলিন্সের লুইজিয়ানা সিটিতে চলে এসেছি। এখানে এই প্রথম আমি। বেশ একা লাগল। প্রথম দুটো দিন অবশ্য গেল খসড়া তৈরি করতে। টাইপরাইটারের একঘেয়ে খটাখট শব্দে ক্লান্তি এসে গেল। মিশরীয় দেবতা নায়ারলাথোটেপ, বুবাস্টিস আর অ্যানুবিস নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে করতে বেজায় বিরক্তি ধরে গেল। ঘরের কোণে বসে থাকতে ভাল লাগল না। শরীরে ঘুণ ধরে গেছে এই দুদিনেই। তৃতীয় দিনে আর পারলাম না। ছড়ানো কাগজ-পত্র ওভাবে রেখেই সন্ধ্যা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম। বুকটা খা খা করছে এক ঢোক পানীয়র জন্য। হাতের কাছের একটা কাফেতে ঢুকে পুরো এক বোতল ব্রান্ডি নিয়ে বসে গেলাম একটা টেবিলে। ঘরটা গরম, লোকের ভিড়ও প্রচুর; আজ কি যেন একটা উৎসব। তাই সবাই বিচিত্র পোশাকে সেজেছে।
চার পেগ গেলার পর পরিবেশটা আর আগের মত অসহনীয় মনে হলো না। আমার পাশে ক্লাউনের পোশাক পরা যে মোটা লোকটাকে দেখে ঘণ্টাখানেক আগে হাসি চাপা দুষ্কর হয়ে পড়েছিল, এখন ওর জন্যেই কেমন মায়া হতে লাগল। মুখোশের আড়ালে লোকটার যাবতীয় দুঃখ কষ্ট আর বেদনার চিত্র যেন উপলব্ধি করতে পারলাম আমি। আশপাশের লোকজনের প্রতিও করুণা বোধ করলাম। ওরা সবাই যেন জাগতিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে এখানে জড় হয়েছে। আমিও তো ওদের মতই একজন।
এসব আগাড়ম বাগাড়ম ভাবতে ভাবতে কখন বোতলটা শেষ করে ফেলেছি মনে নেই। বিল চুকিয়ে পা রাখলাম রাস্তায়, আরেকটু হাটব। তবে এবার আর নিজেকে আগের মত একাকী মনে হলো না। বরং উৎসবের রাজা ভাবতে ভাল লাল নিজেকে প্রতিটি পা ফেলার সময়।
উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে হাঁটতে আমি বোধহয় একটা ক্লাব লাউঞ্জে ঢুকে পড়েছিলাম স্কচ আর সোডা খেতে, মনে পড়ছে না ঠিক। তবে আবার হাঁটা শুরু করি আমি। পা জোড়া কোথায় আমাকে নিয়ে চলেছে নিজেও জানি না। শুধু মনে হচ্ছে ভেসে চলেছি। তবে চিন্তা করার শক্তি হারাইনি।
আমি ভাবছিলাম লেখাগুলো নিয়ে। ভাবতে ভাবতে কখন প্রাচীন মিশরের হারানো সময়ে ফিরে গেছি, কে জানে!
মনে হলো হালকা অন্ধকার, জনশূন্য একটা রাস্তায় ঢুকে পড়েছি আমি।
হাঁটছি থিবস মন্দিরের মাঝখান দিয়ে, ফিংক্স-এর পিরামিডগুলো ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
হঠাৎ মোড় নিলাম আলোকিত এক পথের দিকে। এখানে উৎসবে অংশগ্রহণকারীরা নাচছে।
আমিও মিশে গেলাম সাদা কাপড় পরা পাদ্রীদের মাঝে।
তারপর একের পর এক পাল্টাতে লাগল দৃশ্য।
কখনও মনে হলো ক্রিয়েল শহরে ঢুকে পড়েছি আমি। শহরের লম্বা, উঁচু প্রাচীন বাড়িগুলোর আশপাশ শূন্য, অন্ধকারে ভূতের মত দাড়িয়ে আছে। আবার কখনও মনে হলো একটা হাজার বছরের পুরানো মন্দিরে প্রবেশ করেছি আমি। মন্দিরের সেবা দাসীরা বিশ্বাসঘাতক দেবতা ওসিরিসের রক্তের মত লাল গোলাপ ছিটিয়ে দিচ্ছে আমার গায়ে।
আবার যেন বহু প্রাচীন এক নগরীতে ঢুকে পড়লাম আমি। শত বছরের পুরানো, অন্ধকার বাড়িগুলো দাঁড়িয়ে আছে এক সারে, গাদাগাদি করে। খালি ঘরগুলো যেন কঙ্কালের খুলির মণিহীন কোটর, যেন অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে খুলিগুলোতে।
রহস্য।
মিশরের রহস্য।
ঠিক এই সময় লোকটাকে চোখে পড়ল আমার। অন্ধকার, ভৌতিকূ রাস্তাটা দিয়ে ভোজবাজির মত আমার পাশে উদয় হলো সে। দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ, আমি কি করি যেন দেখতে চায়। দ্রুত পাশ কাটাতে গেলাম, কিন্তু নিথর দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার একটা ব্যাপার আমার নজর কাড়ল হঠাৎ। লোকটার পোশাক-সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক।
ঝাঁকি খেলাম যেন একটা, কল্পনার জগৎ থেকে দ্রুত ফিরে এলাম বাস্তবে।
লোকটার পরনে প্রাচীন মিশরীয় পুরোহিতদের পোশাক।
একি সত্যি দৃষ্টি বিভ্রম নাকি ওসিরিস-এর সাজে সেজেছে সে? ওই লম্বা, সাদা আলখেল্লাটাকে অস্বীকার করি কিভাবে? লোকটার হাড্ডিসার, সরু হাত দুখানা যেন সর্পদেবতা সেট-এর হাত।
লোকটার দিকে স্রেফ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। চোখে চোখ রাখল সে, পাতলা, টানটান মুখখানা শান্ত, অভিব্যক্তিহীন। একটা ঝাঁকি দিয়ে আলখেল্লার মধ্যে হাত ঢোকাল সে দ্রুত। আমি আঁতকে উঠে পিছিয়ে গেলাম, হাতটা বের করল আগন্তুক পকেট থেকে-একটা সিগারেট।