- বইয়ের নামঃ সেবাধর্মে নারী
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
সেবাধর্মে নারী
সেবাধর্ম অবশ্যই মানুষমাত্রেরই ধর্ম। মানবিক সকল গুণের মধ্যে সেবার প্রেরণাই বোধ করি শ্রেষ্ঠ গুণ–স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে। তবু আমাদের চিরন্তন সংস্কারে আর চিরকালীন সংস্কৃতিতে সেবা শব্দটির সঙ্গে নারী শব্দটি যেন একান্তভাবে জড়িত। যেন ঐ নারী শব্দটিই মূর্তিমতী সেবা, মূর্তিমতী করুণা। আমাদের ভাষার ভাণ্ডারে স্ত্রীজাতি সম্পর্কে অনেক প্রতিশব্দই তো রয়েছে, কিন্তু এই শব্দটির মধ্যে যে-লালিত্য, যে-সুষমা, যে-মর্যাদার ব্যঞ্জনা তেমনটি বুঝি আর কোনটিতেই নেই। এ যেন মায়া দয়া স্নেহ মমতা করুণা সান্ত্বনার একটির প্রতীকী নাম।
আমাদের চিন্তায় ও চেতনায় মানবিক সমস্ত গুণগুলির রূপকল্পনাও তো নারীরূপে। দয়া ক্ষমা শ্রদ্ধা ভক্তি স্নেহ। আবার ঐশ্বর্যরূপেও। নারী লক্ষ্মী, নারী অন্নপূর্ণা।
হয়তো বলা হতে পারে, এসব কবি-কল্পনা। ভাবুকের ভাবাবেগের ফসল। কিন্তু সত্যিই কি শুধু তাই? ভাল করে ভেবে দেখলে কি বোঝা যায় না, নারী হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার একটি একান্ত যত্নের সৃষ্টি? এটিকে তিনি একটি বিশেষ অভিপ্রায়ে বিশেষভাবে গড়ে তুলেছেন। তাই তার ওপরেই তার একান্ত বিশ্বাস আর আস্থা। নারীর কাছেই তো গচ্ছিত রাখার ব্যবস্থা জীবজগতের প্রথম প্রাণস্পন্দনটুকু। নারী সেই স্পন্দনের রক্ষয়িত্রী, পালয়িত্রী।
কেবলমাত্র মানবসমাজেই তো নয়, সমগ্র জীবজগতের মধ্যেই তো সৃষ্টিকর্তার এই নিয়মটি বিদ্যমান।
এই নিয়মটিকে কার্যকরী করে তুলতে এবং অব্যাহত ধারায় চালু রাখতে মেয়ে জাতটির মধ্যে বেশ ভালভাবেই তিনি ঠেসে ভরে দিয়ে রেখেছিলেন মমতা আর সেবার প্রেরণা। সেবা হচ্ছে নারীর সহজাত প্রবণতা। বাল্য থেকেই তাদের মধ্যে এই প্রবণতার বিকাশ দেখা যায়। ঘরে ঘরেই দেখা যায়–জননীর প্রতিনিধি অতি ছোট দিদি।
অবশ্য আজকের দিনে নেহাত আধুনিক নাগরিক জীবনে একমেবাদ্বিতীয় সন্তানের ব্যবস্থায় এই দৃশ্যটি বিরল হয়ে আসছে, কিন্তু ঐটুকুই তো সমগ্র সমাজ নয়। গ্রামে গঞ্জে সাধারণ গৃহস্থ সংসারে এই দৃশ্যটি নিতান্ত পরিচিত। পাঁচ-সাত বছরের মেয়েটিও জননীর কর্মর্ভার লাঘব করতে ছোট্ট ভাইবোনকে দেখাশোনা করছে, আগলাচ্ছে, ভিজে কথা বদলে দিচ্ছে। আবার আপন স্নেহ সাধে তাকে টিপ কাজল পরিয়ে, চুল আঁচড়ে দিয়ে সাজাবার চেষ্টায় আলোড়িত হচ্ছে।
ছেলেদের মধ্যে কি এমন প্রবণতা দেখা যায়?
গরিবের বাড়িতে একটি মাতৃহীন সংসারে এমন দৃশ্য বিরল নয় যে, একটি বছর আষ্টেকের মেয়েও তার অপটু হাতে বাপ ভাইয়ের জন্য ভাত রাঁধছে, খাবার জল রাখছে, সাধ্যমতো যত্ন করছে। অথচ তার দশ-বারো বছরের দাদাটি হয়তো এর ওপরও মেয়েটার ত্রুটি ধরছে, ফরমাস করছে। মেয়েটি তবুও দাদার আরাম-আয়েসের ব্যবস্থায় সচেষ্ট সযত্ন। খেটে-খাওয়া গরিব বাপটি গৃহস্থালীর ব্যাপারে ঐ আট বছরের মেয়েটার ওপরই নির্ভরশীল। মেয়েটার আগ্রহ আর দায়িত্ববোধই তাকে নিপুণতার শিক্ষা দেয়।
মেয়েরা সহজাতভাবেই ধরে নেয়, পরিবার-পরিজনদের সেবা করবার, যত্ন করবার আর ব্যবস্থাপনায় নিয়ম-শৃঙ্খলা বজায় রাখবার দায়িত্বটি তারই। এটি যে সবসময় জোর করে বা শাসন করে তার ওপর চাপানো হয়, তা নয়। স্বভাবধর্মেই এ ভার সে নিজের ঘাড়ে তুলে নেয়।
বিত্তবানদের ঘরে অবশ্যই ছবিটি আলাদা। আর যে-ঘরে গৃহিণী নিজেই খুব করিতকর্মা, একাই একশো, সে-ঘরে বালিকা কন্যার হৃদয়বৃত্তির অনুশীলনটি হয়তো বিকশিত হবার সুযোগ পায় না। তবু বাড়ির কেউ যদি এক গ্লাস জল চায়, তাহলে বাড়ির ছোট্ট মেয়েটিই জলের গ্লাসটি এনে তার হাতে ধরে দেয়–মেয়েটির থেকে বড় তার দাদাটি নয়। মেয়েটিও ভাবে না, দাদা দিক।
যে তুলনাগুলি দেওয়া হলো সেগুলি অবশ্য নেহাত ক্ষুদ্র তুচ্ছ ঘরোয়া। আসলে বলতে হয়, এই ভাবধারা আমাদের ভারতীয় জীবনের ভাবধারা। আমাদের মেয়েদের মানসিকতাই শৈশব বাল্য থেকে এই দায়িত্ববোধের অনুপ্রেরণা জোগায়। আর ঐ বালিকা-মূর্তিতে স্নেহ-করুণা সেবার আধার ভাবতে গেলেই মনে ভেসে ওঠে, মা সারদাদেবীর সেই মূর্তিটি
দুর্ভিক্ষের সময় বাবার দাঁতব্যছত্রে ক্ষুধার্তদের সামনে গরম খিচুড়ি ধরে দেওয়া হচ্ছে দেখে ছোট্ট হাতে তালপাতার পাখা নিয়ে সেই খিচুড়িকে ঠাণ্ডা করার প্রয়াস।
এই সেবাময়ী মূর্তিই নারীর আদর্শ। সৃষ্টিকর্তা তাকে সেইভাবেই গড়েছেন। সেবাই নারীর প্রকৃত ধর্ম।
কিন্তু এযুগে–সর্ববিষয়েই যেন প্রকৃতির বিরুদ্ধে আর সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধে একটা জেহাদ ঘোষণাই সমাজজীবনে একটি প্রধান কর্ম বলে বিবেচিত হচ্ছে। হয়তো বা বিরুদ্ধতা করার জন্যেই করা। পরিণামটি শুভ কি অশুভ, সে-চিন্তা না করেই। প্রযুক্তি বিজ্ঞানের উত্তরোত্তর অবিশ্বাস্য সাফল্যের উল্লাসে উল্লসিত মানবসমাজ নিজেকে সৃষ্টিকর্তার প্রতিদ্বন্দ্বীর ভূমিকায় দাঁড় করিয়ে যে উন্মত্ত লড়ালড়ি চালিয়ে চলেছে তার শেষ পরিণাম বিশ্বধ্বংস কিনা কে জানে! যে বিজ্ঞানীরা সাফল্য অর্জনের জন্য পৃথিবীর সমস্ত সঞ্চিত সম্পদ লুঠ করে নিয়ে তাকে নিঃস্ব করে ছেড়ে আপন আপন বিজয় পতাকা ওড়াচ্ছেন, তাঁদেরই কেউ কেউ এখন হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন : বিজ্ঞানের এই শুভাশুভবোধহীন স্বেচ্ছাচারিতার ফলে আজ আকাশে দূষণ, পাতালে দূষণ, সমুদ্রগর্ভে দূষণ, পৃথিবীর প্রতিটি অণু-পরমাণুতে দূষণ! এ চলতে থাকলে পৃথিবীর শেষদিন আসন্ন হয়ে আসবে।