- বইয়ের নামঃ তিন গোয়েন্দা ভলিউম ৯০: খেপা জাদুকর
- লেখকের নামঃ রকিব হাসান
- সিরিজঃ তিন গোয়েন্দা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ রোমাঞ্চকর গল্প
খেপা জাদুকর
এক
তুমি কিন্তু, মুসা, পড়াশোনায় ফাঁকি দিচ্ছ, টিচাররা ইদানীং কথাটা বারে বারে আওড়াচ্ছেন। আমার শেষ রিপোর্ট কার্ড দেখে বাবা-মাও ঠিক একথাটাই বলেছে।
লোকে হয়তো ভাবতে পারে, লেখাপড়ায় মন দিলেই হয়। কিন্তু আমি ব্যাপারটাকে দেখি এভাবে: বই-পত্র থাকবেই। অঙ্ক, ইতিহাস, বিজ্ঞানও থাকবে বহাল তবিয়তে। কিন্তু টিভিতে খেলা দেখা কিংবা নিজে বাস্কেটবল খেলায় সময়টা চলে গেলে আর পাব না। গত শুক্রবার অবশ্য কোচ বলেছেন, আমাকে আরও ভাল করতে হবে। নইলে বাদ দিয়ে দেবেন দল থেকে। আর বাবা-মা যদি আমার টিভি দেখা বন্ধ করে দেয় তো আমি মোটেও অবাক হব না।
তবে একটা কাজ আমি কখনোই ছাড়ব না। সেটা হচ্ছে কাগজ বিলি করা। আমার আয়ের একমাত্র উৎস। কাজেই কাক ডাকা ভোরে বিছানা ছাড়ি আমি, গ্রীনহিলসবাসীদের ঘরে ঘরে কাগজ পৌঁছে দেওয়ার মহান দায়িত্বটা সুষ্ঠুভাবে পালন করি।
আজ সকালে দেখি আমার ক্রেতাদের তালিকায় আরেকটি নাম যোগ হয়েছে। বিল হার্ট। নামটা আগে শুনিনি, তবে ১০০ মেইন স্ট্রীট বেশ পরিচিত শুনিয়েছে আমার কানে। এটাই কি সেই ভুতুড়ে বাড়িটা, আমার জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই যেটাকে খালি, পড়ে থাকতে দেখছি? কে এল ওখানে?
বাইকে চেপে কাগজ বিলি শুরু করলাম। কিন্তু শেষ বাড়িটার কাছাকাছি। হতেই বুক ধুকধুক করতে লাগল। ওই যে, প্রাচীন বাড়িটা দাঁড়িয়ে রয়েছে বিষাদের প্রতিমূর্তি সেজে। শেষ কবে রং করা হয়েছে কে জানে। সামনের উঠনে এক ফুট উঁচু হয়ে আগাছা জন্মেছে। ছেলেপিলেরা রাস্তার শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা এ বাড়িটাকে হানাবাড়ি ভাবে। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। কথাটা এতটাই ছড়িয়েছিল যে, রাশেদ চাচা একবার আমাদেরকে বাড়ির ভিতরটা ঘুরিয়ে নিয়ে গেছেন, ভয় ভাঙানোর জন্য। তাতেও অবশ্য ভয় কাটেনি আমার। সূঙ্গে রাশেদ চাচা ছিলেন, তার উপর দিনের আলো- ভূত দেখা দেবে কেন।
দুরু দুরু বুকে, গোটানো কাগজ ছুঁড়ে দিতে তৈরি হলাম ভাঙাচোরা বারান্দার উপরে। কিন্তু থমকে গেলাম শেষ মুহূর্তে। মান্ধাতা আমলের এক চেয়ারে বসে ধূসর চুলো দাড়িওয়ালা এক লোক। বলে দিতে হলো না ইনিই বিল হার্ট।
গুড মর্নিং, মুসা, বললেন তিনি।
আঁতকে উঠলাম। আমার নাম জানেন বলে নয়, কাগজের সাবসক্রিপশন বিভাগ থেকে নামটা জেনে নিতেই পারেন। চমকেছি ওঁর কণ্ঠস্বর শুনে। রক্ত চলকে উঠেছে বুকের মধ্যে। ইচ্ছে করল এখুনি পালাই। কিন্তু মি. হার্টের পরের মন্তব্যটা আমাকে জায়গায় জমিয়ে দিল।
স্কুলে সমস্যা হচ্ছে, কী, তাই না? লজ্জার কথা। জ্ঞান হচ্ছে শক্তি। কথাটা মনে রেখো।
এতটাই বিস্মিত হয়ে গেছি মুখে কথা ফুটল না। ইনি জানলেন কী করে পরীক্ষায় আমার ফল কেমন হয়েছে? একটু সুস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করতে যাব, মি. হার্ট উঠে পড়লেন। সদর দরজা খুলে পা রাখলেন ভিতরে। হাতে গোটানো এক খবরের কাগজ। খাইছে! আমি তো এখনও ওঁকে কাগজটা দিইনি! আর দেরি নয়, পই পই করে প্যাডেল মেরে স্কুলে চলে এলাম। স্কুলে এসে এত খুশি আগে কোনওদিন হইনি।
কিন্তু বাকি দিনটা কাটল আরও অদ্ভুতভাবে।
মিসেস রবসন যখন শুনলেন আমি আজও হোমওয়র্ক করিনি তখন সবার সামনে বিদ্রূপ করলেন। কেউ কেউ হেসে উঠল। কান গরম হয়ে গেল আমার। কোনও টিচারের উচিত নয় ক্লাসে এভাবে কাউকে অপমান করা। আর করেনও যদি, ক্লাসের সবার উচিত একতা দেখানো- অপমানিত যাতে আরও কষ্ট না পায়। সত্যি বলতে কী, বাস্কেটবল কোচ ম্যাকমোহন যখন সহজ শট মিস করলে কারও উদ্দেশে ধমকে ওঠেন, আমি কখনোই হাসি না। এরপর ইতিহাস ক্লাস। মি. হবসন কালকে একটা অধ্যায় পড়ে আসতে বলেছিলেন। আজ পরীক্ষা নেবেন। কিন্তু হয়েছে কী, আমি ভুলে বইটা ফেলে যাই লকারে। ( পরীক্ষার প্রশ্ন দুটো নিয়ে হিমশিম খাচ্ছি, এসময় আমার চোখ চলে গেল হলওয়ের দিকে। অন্ধকার কোণে কার যেন ছায়ামূর্তি। ধক করে উঠল বুকের ভিতরটা, যখন টের পেলাম ওটা বিল হার্ট। ঠায় দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছেন আমার উদ্দেশে। মুখে অদ্ভুত এক টুকরো হাসি। উনি ওখানে কী করছেন? শিউরে উঠলাম রীতিমত। ভদ্রলোককে আমি ভয় পেতে শুরু করেছি।
দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। ক্লাসরূম থেকে ছুটে পালাতে মন চাইছে। কার জন্য অপেক্ষা করছেন মি. হার্ট? সত্যি বলতে কী, পরীক্ষার চাইতে ওঁকে অনেক বেশি ভয় পাচ্ছি আমি। ইতিকর্তব্য ঠিক করতে না পেরে প্রায় সাদা খাতাই জমা দিলাম। তারপর ডেস্কে ফিরে গিয়ে, বাহু ভাজ করে মাথা রাখলাম।
এর কয়েক মিনিট পর। আশ্চর্য কাণ্ড, শুনতে পেলাম মি. হবসন আমার প্রশংসা করছেন। আমার উত্তর নাকি নির্ভুল হয়েছে। কথাটা শুনে চেয়ার থেকে পড়েই যাচ্ছিলাম আরকী। এবার কেন কে জানে, করিডরের দিকে চকিতে এক ঝলক চাইলাম। ফাঁকা। স্বস্তি বোধ করলাম- যতক্ষণ না কানে প্রতিধ্বনিত হলো অদ্ভুত এক খলখল হাসি। হার্ট, কোনও সন্দেহ নেই। আমার স্থির বিশ্বাস, পরীক্ষার খাতায় ওলটপালটটা সে-ই করেছে। কিন্তু কীভাবে? এবং কেনইবা? ক্লাসের সেরা ছাত্রী, নাক উঁচু লুসি শেরিংহ্যাম আমার দিকে প্রশংসার দৃষ্টিতে চেয়ে। বলতে বাধা নেই, ভাল লাগল আমার।