- বইয়ের নামঃ আই, ডেম আগাথা
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, উপন্যাস
আই, ডেম আগাথা
১. জন্ম হয়েছিল রক্ষণশীল পরিবারে
আই, ডেম আগাথা
জন্ম হয়েছিল আমার রক্ষণশীল পরিবারে।
বৃটিশ সমাজ ব্যবস্থা অনুসারে আমি ছিলাম সেই ফেলে আসা হারানো যুগের প্রতিনিধি। তখনও অবশিষ্ট ছিল ভিক্টোরিয়া যুগের নীলরক্তের অহমিকা। আর মাঝে মধ্যেই সমাজের এখানে ওখানে চোখে পড়তো সন্নিবদ্ধ মানব সভ্যতার অবয়ব। ছোট্টবেলাটা আমার কেটে গিয়েছিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা গ্রাম আর শহরের মধ্যে। ছোট থেকে কেমন ভাবুক আর উদাস প্রকৃতির ছিলাম আমি। সবসময় অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম প্রকৃতির রঙ্গশালার দিকে। দেখতাম কেমন করে সেখানে ঋতু পরিবর্তন হয়। শীতের দিনে হঠাৎ তুষারকণারা এসে ঢেকে দিতে সমস্ত পরিবেশ। মনে হতো প্রাণস্পন্দন স্তব্ধ হয়ে গেছে বুঝি! আবার বসন্ত বাতাস বয়ে যাবার সাথে সাথে চারিদিকে জেগে উঠতে প্রাণের স্পন্দন। পৃথিবী নিজেকে সাজাতে মোহিনী ভালোবাসায়। এইসবই চোখে পড়তে আমার। ছোট থেকেই ছিলাম বেশ ভাবুক প্রকৃতির। সমবয়েসী বন্ধু-বান্ধবদের সাথে খেলাধুলা করতে খুব বেশী ভালো লাগতো না আমার। যখন তারা ব্যস্ত থাকতো খেলার মাঠে, আমি তখন চুপচাপ বসে বসে তাকিয়ে থাকতাম চারপাশের পরিচিত পৃথিবীর দিকে আর অবাক হয়ে দেখতাম মানুষজনের দিকে।
কত বিভিন্ন চরিত্র চোখের সামনে ভেসে উঠতো আমার। মনে হতো, প্রত্যেকেই যেন তাদের না বলা কথা শোনাতে চাইছে। ঐ যে আঙ্কেল পিটার, তার চেহারার মধ্যে কেমন একটা শেয়ালের মত ধূর্ততা লুকিয়ে আছে বুঝি। অথবা আণ্টি মেরী তিনি কি সত্যি সত্যি যীশুর উপাসনা করেন নাকি। এমনভাবেই সকলকে চেষ্টা করেন।
হোটবেলা থেকেই মনে হতো আমার প্রতিটি মানুষ তার মুখের ওপর একটি মুখোশ পরে ঘুরে বেড়ায়। আর এই মুখোশের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা সত্যিকারের মুখের ছবিটি চোখের সামনে ফুটিয়ে তুলতেই বুঝি আগ্রহী ছিলাম আমি। কে জানে হয়তো তখন থেকেই মনে মনে স্থির করেছিলাম ভবিষ্যতে আমাকে হতে হবে একজনের রহস্য কল্পকার। তাহলেই পৃথিবীর অনেক গোপন রহস্য সহসা উন্মোচিত হয়ে যাবে আমার কাছে।
দেখতে দেখতে অতিক্রান্ত হলো ছোটবেলার সুন্দর সোনালী দিনগুলো, আমি পা রাখলাম কৈশোর কালে। তখনও আমার মনের মধ্যে অনুসন্ধিৎসা কিন্তু একেবারে নির্বাপিত হলো না। তখন আমার পরিধি অনেক বৃহত্তর হয়ে গেছে। আমি পরিচিত বন্ধু-বান্ধবদের গণ্ডী পার হয়ে হাজির হয়েছি আরো অনেক নতুন মানুষের সন্ধানে। নিত্য নতুন মানুষ এসে কড়া নাড়ছে মনের দরজায়। কি বিচিত্র তাদের রূপ, কি অদ্ভুত তাদের প্রকৃতি। সকলেরই বোধহয় সেই না বলা কথার অ্যালবাম কখনও রয়ে গেছে মনের মধ্যে জমা, আর আমাকেই দায়িত্ব দিয়েছে তারা, তার থেকে সুন্দর কাহিনী বের করে সকলের সামনে উপস্থাপিত করতে।
ছোট থেকেই ডায়েরি লেখার শখ ছিল আমার। ডায়েরির মধ্যে লিখে রাখতাম নানা অদ্ভুত ঘটনাকে। পরবর্তীকালে আমার অনেক গল্পের উপকরণ হিসাবে আমি ব্যবহার করেছি ডায়েরির সেইসব ঘটনাকে।
খবরের কাগজের পাতায় চোখ রাখতে ভীষণ ভালোবাসতাম। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তাম সমস্ত সংবাদ। হঠাৎ কোথাও ঘটে যাওয়া কোন হত্যাকাণ্ডের খবরে আমি কেমন বিচলিত বোধ করতাম। আর ভাবতাম এর অন্তরালে নিশ্চয়ই কোন এক রহস্য লুকিয়ে আছে। নাহলে মানুষ কেন ফুলের মত নিষ্পাপ আর একটি মানুষকে অকারণে সরিয়ে দেবে পৃথিবীর বুক থেকে।
এমনভাবেই তৈরী হতে থাকে আমার অনুসন্ধিৎসু মন। আর কোহলী মনন আর নিজেকে আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকি ভবিষ্যতের লেখিকার পদে আসীন হবো বলে।
ইতিমধ্যে একটি ঘটনাতে ইংল্যাণ্ড জুড়ে দারুণ হৈ চৈ সৃষ্টি হয়েছিলো।
দুই কিশোরী মেয়েকে কে বা কারা রাতের অন্ধকারে শ্বাসরোধ করে খুন করে খামারবাড়ীতে তার মৃতদেহ ফেলে পালিয়ে যায়। যথানিয়মে পুলিশ আসে। সমস্ত সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় বড় বড় অক্ষরে প্রকাশিত হয়, এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সচিত্র বিবরণ। তারপরেই আমার মনে হয়েছিলো, এর ভেতরে নিশ্চয়ই কোন আত্মীয়স্বজন উপস্থিত আছে। তা নাহলে বাইরের কারো পক্ষে এমনভাবে ঐ প্রাসাদোপম দুর্গ বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে দুটি মেয়েকে হত্যা করা কোনমতেই সম্ভব নয়। এমন কি আমার মনের এই অনুমানের কথাটা জানিয়ে দিলাম বাবাকে। বাবা প্রথমে বিশ্বাস করতে চান নি। এ তাঁর কিশোরী মেয়ের নেহাতই কল্পনার কথা। কিন্তু সত্যি সত্যি একদিন গোয়েন্দারা বের করে আনলো যে, ঐ দুটি নিষ্পাপ কিশোরীর সম্মাই ছিলো তাদের খুনের অন্তরালে। তখন সমস্ত পরিবারে আমার সম্মান ও খাতির এক মুহূর্তে অনেকখানি বেড়ে গেল। সকলে আমাকে ডাকতে লাগলো খুদে গোয়েন্দা বলে। আর মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ইচ্ছের পাখী আকাশে মেলে দিলো তার ডানা। সত্যি সত্যি আমি বোধহয় তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ শক্তির সাহায্যে একের পর এক রহস্য বের করে পৌঁছে যাবো আমার নির্দিষ্ট লক্ষ্যপথে, এমনটি ধারণা হতে লাগলো আমার।
স্কুলের অবসরে, ছুটির সময়, বরষার সন্ধ্যায় আমি মাঝে মধ্যেই কাগজের ওপর কিছু কিছু গল্প লেখার চেষ্টা করতাম। গল্প না বলে সেগুলোকে বরং বলা যেতে পারে গল্পের খসড়া। সেই খসড়া থেকেই স্কেচের মত অনেক ছোট গল্পের জন্ম হয়েছে ভবিষ্যতে, আর সতেরো বছর বয়েসেই আমি প্রথম একটি উপন্যাস লেখার চেষ্টা করি। পরবর্তীকালে অবশ্য এই উপন্যাসটি প্রকাশ করিনি। কিন্তু আমার মনে এই উপন্যাস যথেষ্ট প্রেরণার সৃষ্টি করে। এই প্রথম আমি বিচিত্রতর ক্যানভাসে অনেকগুলি চরিত্রের মাধ্যমে অনেক কথাকে প্রকাশ করতে পেরেছিলাম কাগজ আর কলমের সাহায্যে। হলোই বা এক ব্যর্থ প্রয়াস। কিন্তু ভবিষ্যতে সাহিত্য জীবনে চলার পথে এই উপন্যাসটির নাম আমি কোনদিন মুছে ফেলতে পারবো না। পড়াশুনার পাট শেষ করে যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করি তখন আমার মধ্যে একটি বোধ জেগে ওঠে যে, আর কিছু নয়–পেশাগতভাবেই আমাকে লেখিকা হতে হবে। কেননা পেশার সঙ্গে লেখাকে যোগ না করলে আমি কোন দিন পৌঁছতে পারবো না আমার স্বপ্নের রাজপথে। আমাকে চিরদিনেই শখের লেখিকা হিসেবে পরিচিত হতে হবে, যা মোটেই কাম্য নয়। তাই শুরু হলো আমার সারাদিন রাতের প্রয়াস। এমন কি রাতের পর রাত কাটাতে লাগলাম আমার নিরন্তর সাধনাতে। আর ঠিক অবসরে আত্মপ্রকাশ করে আমার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস