অন্তরভেদী অবলোকন
কাল মৃত্যু হাত বাড়িয়েছিলো আমার ঘরে। জানলার
ফাঁক দিয়ে সেই দীর্ঘ হাত অন্ধের অনুভব শক্তির মতো
বিছানার ওপর একটু একটু এগোল। আমার স্ত্রী শিশুটির
মাথায় পানির ধারা দিচ্ছিলেন। তার চোখ ছিল পলকহীন, পাথর।
স্তন দুটি দুধের ভারে ফলের আবেগে ঝুলে আছে!
পানির ধারা প্রপাতের শব্দের মতো হয়ে উঠে সবকিছুতে
কাঁপন ধরিয়ে দিলো। লুণ্ঠনের আলো ময়ূরের পালকের
অনুকরণে কাপতে লাগলো। অবিকল।
আর সেই হাত, বালিশের কাছে এসে পড়েছে, আমি
দেখলাম। স্ফীত শিরা, নখ কাটা হয়নি। রোমশ।
আমার চীৎকার করতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু মৃত্যুর সামনে আমি
কোনদিন শব্দ করতে পারি না।
সেই হাত জাপটে ধরতে ক্রোধ হলো। কিন্তু মৃত্যুর শক্তি
সম্বন্ধে আমি জানতাম, আমার ধারণা ছিল।
তবে কি প্রার্থনা করবো? না, মৃত্যু তো চেঙ্গিসের
অন্ধের মতো দ্রুতগামী, বধির।
–কে? কে?
জলের ধারা থমকে গেল। আমার স্ত্রী চোখ তুলে
তাকালেন। তার নগ্ন হাতে শূন্য জলপাত্র। ব্লাউজের বোতাম
খুলে গিয়ে ‘ম’-এর আকারের মতো কণ্ঠা উদোম হয়ে আছে।
নির্জল চোখে অন্তরভেদী অবলোকন।
আমি মৃত্যুর দিকে তাকালাম। দেখি, কুকুরের লেজের
মতো সে জানলার দিকে গুটিয়ে যাচ্ছে। নখ কাটা হয়নি,
স্ফীতশিরা রোমশ।
অবগাহনের শব্দ
জানি না কি ভাবে এই মধ্যযামে আমার সর্বস্ব নিয়ে আমি
হয়ে যাই দুটি চোখ, যেন জোড়া যমজ ভ্রমর পাশাপাশি
বসে আছে ঈষদুষ্ণ মাংসের ওপর।
চেতনাচেতনে যেন হেঁটে যায় অন্ধকার। সাপের জিহ্বার মতো দ্রুত কম্পমান
অনুভূতি ইয়ে যায় এলোমেলো রক্তের পর্দায়।
আমার সমস্ত মর্মে যেন এক বালকের বিদায়ের বিষণ্ণ লগন।
লেগে থাকে। সর্বশেষ আহার্যের থালা থেকে উষ্ণ গন্ধময়
ধোঁয়া হয়ে উড়ে এসে নাকে লাগে মায়ের আদর।
বিদায়, বিদায় দাও হে দৃশ্য, যে জন্মান্ধ পশ্চাৎ
আর কেন লগ্ন হও, অন্ধকার হয়ে থাক গাছপালা বাসস্থান নদী
পাখির ডাকের মতো অন্তর্হিত হয়ে যাও অমলিন গভীর সবুজে।
নদীর শরীর ঘেঁষে যেতে চেয়ে দেখি ওপারে হঠাৎ
আলোর গোলক হয়ে উঠলেন দিনের শরীর।
অবগাহনের শব্দে ছল ছল ঘাটের পৈঠায়
কে যেন বললো স্নেহে সঙ্গিনীকে,
চেয়ে দেখ্ অই
কোন মা মাঘের ভোরে প্রাণ ধরে ছেড়েছে এমন
দুধের দুলাল তার। কুয়াশায় হেঁটে যাচ্ছে, আহা কি কষ্টের।
পাখি ওড়া দেখা আর হেঁটে যাওয়া নদীর পেছনে দিনমান
যেন আর খেলা নয়। ঘাম জমে ললাটে চিকন
হাঁটুতে ধুলোর দাগ। হাত তুলে আলোকে আড়াল
এখন হবে না আর। তুঙ্গ হয়ে দিনের দেবতা অগ্নিময় আকাশে গেলেন।
আবার জলের শব্দে চেয়ে দেখি, অবগাহনের পালা
ঘাটময় গ্রামের মেয়েরা আমারে দেখিয়ে বলে, কে অই পুরুষ যায়
কোন গায় জানি কোন রূপসীর ঘরে।
তৃষ্ণা মরে গেলে পরে স্বেদবিন্দু হাওয়ায়
কখন শুকায় ফের। চরের পাখিরা
মুখ চাওয়াচাওয়ি করে অবশেষে উড়ে যায় রক্তাভ ডানায়।
বড় অবসাদ লাগে। দুঃখ নয় যাঞ্চা নয় বুঝি কোন পিপাসা আমাকে
করে না তাড়না আর। কোন ঘাটে এসেছি জানি না
অষ্টাদশ কলসী নিয়ে ঘরে ফিরে বধূরা এখন।
কে নারী বললো বড় গাঢ় স্বরে, পার হয়ে অন্ধকার বিল
জানি কোথায় যাবে এই বৃদ্ধ পথিক পুরুষ।
আঘ্রাণে
আজ এই হেমন্তের জলদ বাতাসে
আমার হৃদয় মন মানুষীর গন্ধে ভরে গেছে।
রমণীর প্রেম আর লবণসৌরভে
আমার অহংবোধ ব্যর্থ আত্মতুষ্টির ওপর
বসায় মর্চের দাগ, লাল কালো।
কটু ও কষায়।
প্রতিটি বস্তুতে দেখি লেগে আছে চিহ্ন মানবীর
হাওয়ায়, জলের ঢেউয়ে, গুমের স্তবকে স্তবকে
বইছে নারী ঘ্রাণ কমনীয় যুগান্তসঞ্চারি।
গণ্ডুষে তুলেছি জল, টলমল–
কার মুখ ভাসে?
কে যেন কিশোরী তুমি আমারি কৈশোরে
নেমেছিলে এ নদীতে। লেগে আছে
তোমারি আতর।
হে বায়ু, বরুণ, হে পর্জন্য দেবতা
তোমাদের অবিরল বর্ষণে ঘর্ষণে
যখন পর্বত নড়ে, পৃথিবীর চামড়া খসে যায়
তবু কেন রমণীর নুন, কাম, কুয়াশার
প্রাকৃতিক গন্ধ লেগে থাকে?
হে বরুণ, বৃষ্টির দেবতা!
আত্মীয়ের মুখ
আহমেদুর রহমান স্মরণে
কেউ কেউ আছেন মনে, যেন কোনো আত্মীয়ের মুখ
বুকের ভেতর থেকে হেসে ওঠে, মৃদু শব্দে জিজ্ঞাসে কুশল
আর আমি আমার চেয়ার ছেড়ে নৈশব্দের মধ্যে হেঁটে গিয়ে
নতুন সিগ্রেটকেস খুলে ধরে বলি,
যেখানে গেলেন সেখানে রয়েছে নাকি অবসান?—
আমাদের এই দীন সামান্য জগতে
মনুষ্যভাষার কোষে, কয়েকটি অলীক শব্দে
আছে যার দয়ার্দ্র কলাপ!
বইয়ের দোকান যদি নেই, কেননা তবে সেখানে গমন?
সকালে সংবাদপত্র, রাজনীতি, ক্ষুব্ধ খোঁচাখুঁচি
যা কিনা রক্তাক্ত শার্টের মতো পরে আছে আমাদের ভয়ার্ত শতক—
এসবের উর্বে আজ বিনাবাক্য ব্যয়
কি করে থাকেন?
জানি না, দেশের খবর কিছু পান কিনা,
কি ঘটবে এশিয়ায়—এ নিয়ে তর্ক করে আপনার যাওয়ার পর
পৃথিবীর সবকটি সাদা কবুতর
ইহুদী মেয়েরা বেঁধে পাঠিয়েছে মার্কিন জাহাজে।
আভূমি আনত হয়ে
এ ঘুরে দাঁড়ানো নয়, শুধু আভূমি আনত হয়ে থাকা
দৃশ্যের আঘাত থেকে মুদে রাখা চোখের প্রতিভা!
চোখ বড়ো সাংঘাতিক রক্তের প্রান্তর ছুঁয়ে থাকে—
নিসর্গ নিবন্ধ করে দেখে নেয় নারী আর নদীর নিতল।
ধরে রাখে মাছ পাখি পা আর পতঙ্গের প্রসঙ্গ সকল
সমস্ত সম্বন্ধসূত্র ভেদ করে আনে তীব্র চাক্ষুষ প্রমাণ।