- বইয়ের নামঃ মহৎ জীবন
- লেখকের নামঃ লুৎফর রহমান
- প্রকাশনাঃ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র
- বিভাগসমূহঃ আত্মজীবনী
১. মহৎ জীবন
সমুদ্রগর্ভে মালোকাই দ্বীপে কুষ্ঠব্যাধিগ্রস্ত নর-নারীকে নির্বাসনে দেওয়া হতো। কেউ তাদের দেখবার ছিল না, ব্যাধি যন্ত্রণায়, দুঃখে তাদের জীবন শেষ হতো। চারিদিকে সমুদ্র, তার মাঝে আর্ত নর-নারী, বালক-বালিকা নিজেদের দুর্ভাগ্য ও আশাহীন, সান্ত্বনাহীন জীবন নিয়ে মৃত্যুর অপেক্ষায় কাল কাটায়। তারা আল্লাহকে ডাকত না, তাদের কোনো ধর্মজীবন ছিল না। তারা নিরন্তর ব্যাধি যন্ত্রণায় হা-হুঁতাশ করতো, আর অদৃষ্টকে অভিশাপ দিত। যাদের জীবনে কোনো আশা নাই, যারা আত্মীয়-পরিজন হতে বিচ্ছিন্ন হয়েছে, যাদের কোনো সমাজ নাই, যাদের কেউ শ্রদ্ধা করবার নাই, যাদের দুঃখ-ব্যাথার কথা কেউ চিন্তা করে না–তাদের জীবন কত ভয়ানক, কত দুঃখময়, কত শোচনীয়!
এই অভিশপ্ত ও নির্বাসিত নর-নারীর জন্য কার প্রাণ অস্থির হয়েছিল? তাদের দুঃখের জীবন কার প্রাণে চিন্তা সৃষ্টি করেছিল? কে এই নির্বাসিতদের মাঝে যেয়ে তাদের সেবা করবে? তাদিগকে সান্ত্বনা দেবে? তাদেরকে আল্লাহ্ ও মহৎ জীবনের কথা শোনাবে? তারা যে অভিশপ্ত! কে যাবে সেই দুঃসহ ব্যাধির সংস্পর্শে? তাদের কাছে যাওয়ার অর্থ–নিজের জীবনের সকল আশা-ভরসা জলাঞ্জলি দেওয়া এবং প্রয়োজন হলে কুষ্ঠব্যাধিকে বরণ করে নেওয়া।
দামিয়ান নামক এক যুবক বহুদিন হতে এই নির্বাসিতদের কথা চিন্তা করেছিলেন। এই সুন্দর আকাশ, এই আলো গন্ধভরা মানব-সমাজ, জীবনের সহস্র ভোগ-আকর্ষণ একদিকে, অন্যদিকে রোগপীড়িত নর-নারীর করুণ মুখ–আতুরের গগনবিদারী চিৎকার–আর সীমাহীন আঁধারে ব্যথিতের করুণ মুখেরই জয় হল। জীবনের সকল আশা কামনাকে বিসর্জন দিয়ে যুবক দামিয়ান নির্বাসিত কুষ্ঠব্যাধিগ্রস্তদের সেবার জন্য প্রস্তুত হলেন, বন্ধু প্রতিবেশীদের সমালোচনা, আত্মীয়-স্বজনের মিনতি তার সঙ্কল্পকে দমাতে পারলো না। দামিয়ান একদিন ফরাশি দেশের উপকূলকে শেষ নমস্কার করে একখানি বাইবেল আর একটা সাগরের মতো বিরাট আত্মা নিয়ে আর্তের সেবায় সমুদ্রপথে যাত্রা করলেন। আহা! বিরাট মনুষ্যত্ব! যে জীবন সহস্র ভোগের শিক্ষা দিয়ে উজ্জ্বল করে তোলা যেতো সীমাহীন সুখ দিয়ে যাকে ভরে দেওয়া যেতো, তা এখন দুস্থ নর-নারীর চিৎকার ক্রন্দনের মাঝে ব্যয়িত হতে লাগলো। দামিয়ান পিতার মতো, মায়ের মতো, বন্ধুর মতো ব্যাধিগ্রস্ত মানুষগুলিকে সেবা করতে লাগলো। তিনি যখন তাদিগকে নিয়ে সাগরকূলে বসে। আল্লাহর স্নেহের কথা বর্ণনা করতেন–যখন তিনি বলতেন, মানুষের জন্য এক অফুরন্ত আনন্দের রাজ্য আছে, আমরা সেই দিকে যাচ্ছি–ব্যাধিপীড়া দিয়ে খোদা আমাদেরকে তার অসীম স্নেহের পরিচয় দিচ্ছেন, তখন সবাই কাঁদতো, আকাশ থেকে ফেরেস্তা আশীর্বাদের অশ্রু দিয়ে তাদের সংবর্ধনা করতো, স্তব্ধ সমুদ্রের বুকের উপর দিয়ে বাতাস তাদের শোক গৌরব গেয়ে ফিরতো।
কী মহৎ এই মহাপুরুষের জীবন–কত বড় তিনি ছিলেন।
ঊনিশ বছরের সেবার পর দামিয়ান একদিন বুঝতে পারলেন–কাল ব্যাধি তাকেও ধরেছে। তিনি সেদিন সকলকে এক জায়গায় করে বললেন, আজ আমার আনন্দের সীমা নাই। আজ তোমাদেরই মতো আমি একজন হয়েছি। এতদিন তোমাদের সঙ্গে আমার ভালো করে আত্মীয়তা হয় নাই, একটু বিভেদ ছিল,–আজ খোদা সে বিভেদটুকু তুলে নিয়ে তোমাদের সঙ্গে আমায় এক করে দিয়েছেন। আজ তাঁর স্নেহের কথা স্মরণ করে
আমাদের চোখে পানি আসছে। আজ আমাদের উপাসনা বড় মধুর, বড় সুন্দর হবে।
ক্ৰমে দামিয়ানের সোনার শরীর ভেঙ্গে এল। অবশেষে এই মহাপুরুষ মানব-সমাজে তার মহৎ জীবনের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে একদিন প্রাণত্যাগ করলেন। দামিয়ান মরেন নি–মানুষ চিরকাল তাঁর স্মৃতির সম্মান করবে।
এ জগতে মানুষ নিজের সুখের জন্য কত লালায়িত, মানুষের সহানুভূতি ও বেদনাবোধ কত সুন্দর, কত মহৎ–মানুষ তা কবে বুঝবে? প্রকৃত সুখ কোথায়? পরকে ফাঁকি দিয়ে নিজেই সুখটুকু ভাগ করে নেওয়াতে কি সত্যিকারে সুখ আছে? আত্মার সাত্ত্বিক তৃপ্তির কাছে জড় দেহের ভোগ-সুখের মূল্য কিছুই না। যতদিন না মানুষ পরকে সুখ দিতে আনন্দ বোধ করবে, ততদিন তার যথার্থ কল্যাণ নাই। আর্তক্ষুধিত আমার সামনে আঁখিজলে ভেসে বেড়াচ্ছে, আমি কোন প্রাণে আনন্দ-উৎসবে যোগ দেব? আর্তের দুঃখের মীমাংসা চাই, ক্ষুধিতের শান্তি চাই।
মানুষের জড়দেহের ব্যথার জন্য যে বেদনাবোধ, এ ছাড়া আর এক প্রকার বেদনাবোধ আছে। জ্ঞান ও অজ্ঞানে মানুষের আত্মার যে অবনতি ঘটে, তা দেখে মহাপ্রাণ ব্যক্তিরা যে বেদনাবোধ করেন, তাও সমান মহত্ত্বের পরিচায়ক। আত্মার দারিদ্র্য ও মানুষের শরীর-মন উভয়কেই ধ্বংস করে।
মানুষের পাপ মানব-সমাজকে মৃত্যুর পথে টেনে নিয়ে যায়। তার জন্য অসীম দুঃখ সৃষ্টি করে। পাপী শুধু নিজে পাপ করে না, তার অত্যাচারের আঘাত সহ্য করতে যেয়ে মানব-সমাজের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যায়। যে মানুষের চোখ থেকে রক্ত টেনে বের করে মানব হৃদয়ে চিতার আগুন জ্বেলে দেয়, সে জীবন্ত অভিশাপ হয়ে এ জগতে বাস করে। সে নিজের বুকে ছুরির আঘাত করে অথচ সে বুঝতে পারে না, সে কি করছে।