অন্দরমহল
রাজা মোহন সিং ভারি অদ্ভুত ঢঙে রাজ্য চালান। ওর বক্তব্য, কাউকে বিশ্বাস কোরো না। চরের পিছনে চর লাগাও। গোটা রাজ্যের সমস্ত খবর উনি আট রকম বিবৃতিতে পান। একটা দিয়ে উনি অন্যটা বিচার করে দেখেন। উপরন্তু আজকাল উনি একটা নতুন কাজও করেন। গলস্টন সাহেবকে দিয়ে উনি যে একটি বিলেতি বই অনুবাদ করিয়েছেন সেটা দিনে ঘণ্টাখানেক পড়েন। বইটা মাকিয়াভেলির প্রিন্স। থেকে থেকে পড়ার সময় মোহন সিং বলে বসেন, বহুত আচ্ছা!
ইদানীং রাজ্যে তাই টু শব্দটিও কারোর থেকে শোনা যায় না। কিন্তু মোহন সিং একটা নতুন ব্যাপারে বড় ভাবিত হয়ে পড়েছেন। প্রাসাদের চর ভারবু খবর দিয়েছে রানি সুখীন্দরের কাছে রাতে দেখা করতে আসে সেনাপতি ভীমসিংয়ের ছেলে সুন্দর। দালান পাঁচিল টপকে রানির ঘরে ঢুকে খিল মেরে বসে থাকে বহুক্ষণ। তারপর ভোরের আগে-ভাগে পালায়। সুন্দর কীভাবে না কীভাবে জানতে পারে কোন কোন দিন রাজা যাবেন না রানির কোঠায়। এই জানা অবধি মোহন সিংয়ের ঘুম চলে গেছে। যদি কাউকে জীবনে তিনি বিশ্বাস করে থাকেন তবে তা রানি সুখীন্দরকে। বয়সে রাজার চেয়ে অন্তত বিশ বছরের ছোটো হলেও সুখীন্দরের বুদ্ধি খুব পাকা। যেদিন বিয়ে করে এনেছিলেন সেদিন আগের রানির আত্মীয়েরাও স্বীকার করেছিলেন, না, রাজা কাজটা ভালোই করেছেন।
সুখীন্দর কিন্তু মাঝেমধ্যেই রাজাকে বলেন, আপনার এত সন্দেহ বাতিক কেন? রাজ্যে যা হবার হবে। তাতে দিনরাত অতশত গুপ্তচর লাগিয়ে কী হবে?
রাজা তখন হাসেন। বলেন, এক তোমাকে ছাড়া আমার আর কারোকেই তো বিশ্বাস করা ঠিক না। চার-চারটে ঝি রেখেছি বলেই না বড়োরানি তোমাকে বিষ খাইয়ে মারতে পারছে না। এই প্রত্যেকটা ঝি প্রত্যেকটা ঝিয়ের খবর এনে দেয় দেওয়ান সাহেবকে। সেটা জান কী?
এখন সেই সুখীন্দরই চুপিসাড়ে প্রেম করছেন সুন্দর সিং-এর সঙ্গে। রাজা রাগে হাত কামড়াচ্ছেন। উনি ডেকে পাঠিয়েছেন কালু খাঁকে সুন্দরকে ধরার ব্যবস্থা করতে। কাল্প এক
সময় মোহন সিংয়ের বাবা দরবার সিংয়ের বডিগার্ড ছিল। নৃশংস ব্যাপারে ওর জুড়ি নেই সারাহিন্দুস্থানে। ওরই ছেলে এখন হিন্দুস্থানের বাদশাহ বাহাদুর শাহের সেনাদলে ভরতি। এক এক গুলিতে দু-দুটো লোক জখম করতে পারে।
কালু এসে একটা চমৎকার সমাধান দিল। বলল ইঁদুর ধরার মতো ফাঁদ পেতে সুন্দরকে পাকড়াও করা হোক। পরদিন শহরের লোকের সামনে ওর ফাঁদের দড়িটা দু-দুটো ষাঁড়ের গলায় বেঁধে ষাঁড় দুটোকে বিপরীত দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া যাক। এভাবে বড়ো জোর পনেরো মিনিটে সুন্দর সিংয়ের দেহটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে! ওই দেখে শহরের আর যারা অন্যের বউদের সঙ্গে ফস্টিনষ্টি করে তারা তাদের ভবিষ্যৎটা বুঝে যাবে। মতলব শুনে মোহন সিং যার পর নাই খুশি হয়েছেন। এই ক-দিনে সুখীন্দরের উপর ভালোবাসাটা তীব্রভাবে বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে বেড়ে গেছে সুন্দরের ওপর রাগ এবং ঘৃণা। প্রতিহিংসার জেদটা এখন টগবগ করে ফুটছে রাজার অন্তরে।
ঠিক হল রানির কোঠায় যাবার জন্য সুন্দর যেদিকটা দিয়ে পাঁচিল টপকায় সেখানে একটা মোটা দড়ির জাল পাতা হবে। দেওয়াল বেয়ে সুন্দর যখন উঠবে, ওর নিজের হাতের টানেই একসময় দড়ির জাল ওর গায়ে নেমে আসবে। সকাল বেলায় ওই অবস্থাতেই ওকে রানির কোঠার সামনে ষাঁড়ে টানানো হবে। যেহেতু আর কেউ জানে না কেন সুন্দরকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে ওকে জালে বাঁধা অবস্থাতে দেখলে লোকে জানবে হারামজাদা নিশ্চয়ই কোনো কুকর্ম করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। এবং রানি সুখীন্দরকেও রাজা জানতে দিতে চান না যে, তিনি ওদের ব্যাপারটা পুরো জানতেন, তাই ওর জানলার সামনে সুন্দরকে মারা হলে রানি নিজেও ভবিষ্যতে ওরকম প্রেমটেম আর করবেন না। গলস্টন সাহেবই একসময় রাজাকে বুঝিয়েছিলেন যে, খোদ শাস্তির চেয়ে শাস্তির ভয়টাই মেয়েদের বেশি। ব্যাখ্যাটা রাজার খুব মনে ধরেছিল।
সুখীন্দর ওঁর জানালা দিয়ে প্রেমিকের আসার পথটা দেখছিলেন। একফালি চাঁদ তখন আকাশে। সুখীন্দরের কোঠায় কোথাও একটা বাতি জ্বলেনি। গত সাত দিন ধরে সুন্দর ক্রমাগত কবিতা শুনিয়েছে ওকে। সুন্দর কবিতা খুব একটা ভালো বলতে পারে না, কিন্তু অজস্র ভাব আছে গলায়। প্রদীপের আলোয় ও যখন কবিতা পড়ে তখন সুখীন্দর এক মনে ওর মুখটা দেখেন। সুন্দরের ঠোঁটটা সাধারণ পুরুষের তুলনায় সরু, কিন্তু ওর চোখগুলো গভীর। ও কখনও শরাব পান করে না। কবিতা পড়ার সময় ওর চোখ দুটো দপ দপ করে জ্বলে ওঠে জায়গায় জায়গায়। গত তিন দিন ধরে ও সুখীন্দরকে চুমু খেতে চাইছে। সুখীন্দর হয়তো আজ ওকে সেই অনুমতি দেবেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত দেবেন কী?
সুখীন্দরের বোধ হয় একটা তন্দ্রার মতন এসেছিল। আচমকা ঘোর ভাঙতে দেখলেন সুন্দর একটা মস্ত জালের মধ্যে লটকে গিয়ে আপ্রাণ পালাবার চেষ্টা করছে। আর যতই চেষ্টা করছে। ততই যেন কে বা কারা আরও জোর দিয়ে টেনে টেনে জালটা বসিয়ে দিচ্ছে ওর শরীরে। সুন্দর কয়েকবার সুখীন্দরের নাম ধরে ডাকল, কিন্তু সুখীন্দর সাড়া দিতে গিয়ে চুপ করে গেল। কী সর্বনাশ! কেউ যদি শুনে ফেলে? স্বয়ং রাজাই যদি শোনেন? সুখীন্দর আঁচলে মুখ চাপা দিয়ে পালঙ্কের ওপর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। বার বার মনে পড়তে লাগল সুন্দরের সরু ঠোঁট আর জ্বলজ্বলে চোখ দুটো।