- বইয়ের নামঃ পূর্বাভাস
- লেখকের নামঃ সুকান্ত ভট্টাচার্য
- প্রকাশনাঃ জয় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অসহ্য দিন
অসহ্য দিন! স্নায়ু উদ্বেল। শ্লথ পায়ে ঘুরি ইতস্তত
অনেক দুঃখে রক্ত আমার অসংযত।
মাঝে মাঝে যেন জ্বালা করে এক বিরাট ক্ষত
হৃদয়গত।
ব্যর্থতা বুকে, অক্ষম দেহ, বহু অভিযোগ আমার ঘাড়ে
দিন রাত শুধু চেতনা আমাকে নির্দয় হাতে চাবুক মারে।
এখানে ওখানে, পথে চলতেও বিপদকে দেখি সমুদ্যত,
মনে হয় যেন জীবনধারণ বুঝি খানিকটা অসঙ্গত।।
আমার মৃত্যুর পর
আমার মৃত্যুর পর থেমে যাবে কথার গুঞ্জন,
বুকের স্পন্দনটুকু মূর্ত হবে ঝিল্লীর ঝংকারে
জীবনের পথপ্রান্তে ভুলে যাব মৃত্যুর শঙ্কারে,
উজ্জ্বল আলোর চোখে আঁকা হবে আঁধার-অঞ্জন।
পরিচয়ভারে ন্যুব্জ অনেকের শোকগ্রস্ত মন,
বিস্ময়ের জাগরণে ছদ্মবেশ নেবে বিলাপের
মুহূর্তে বিস্মৃত হবে সব চিহ্ন আমার পাপের।
কিছুকাল সন্তর্পণে ব্যক্ত হবে সবার স্মরণ।
আমার মৃত্যুর পর, জীবনের যত অনাদর
লাঞ্ছনার বেদনায়, ষ্পৃষ্ট হবে প্রত্যেক অন্তর।।
আলো-অন্ধকার
দৃষ্টিহীন সন্ধ্যাবেলা শীতল কোমল অন্ধকার
স্পর্শ ক’রে গেল মোরে। স্বপনের গভীর চুম্বন,
ছন্দ-ভাঙা স্তব্ধতায় ভ্রান্তি এনে দিল চিরন্তন।
অহর্নিশি চিন্তা মোর বিক্ষুব্ধ হয়েছে; প্রতিবার
স্নায়ুতে স্নায়ুতে দেখি অন্ধকারে মৃত্যুর বিস্তার।
মুহূর্ত-কম্পিত-আমি বন্ধ করি অলৌকিক গান,
প্রচ্ছন্ন স্বপন মোর আরিক মিথ্যার পাষাণ,
কঠিন প্রলুব্ধ চিন্তা নগরীতে নিষ্ফল আমার।
তবু চাই রুদ্ধতায় আলোকের আদিম প্রকাশ,
পৃথিবীর গন্ধ নেই এমন দিবস বারোমাস।
আবার জাগ্রত মোর দুষ্ট চিন্তা নিগূঢ় ইঙ্গিতে;
ভুঁইচাঁপা সুরভির মরণ অস্তিত্বময় নয়,
তার সাথে কল্পনার কখনো হবে না পরিচয় ;
তবু যেন আলো আর অন্ধকার মোর চারিভিতে।।
আসন্ন আঁধারে
নিশুতি রাতের বুকে গলানো আকাশ ঝরে –
দুনিয়ায় ক্লান্তি আজ কোথা?
নিঃশব্দে তিমির স্রোত বিরক্ত-বিস্বাদে
প্রগল্ভ আলোর বুকে ফিরে যেতে চায়।
-তবে কেন কাঁপে ভীরু বুক?
স্বেদ-সিক্ত ললাটের শেষ বিন্দুটুকু
প্রখর আলোর সীমা হতে
বিচ্ছিন্ন করেছে যেন সাহারার নীরব ইঙ্গিতে।
কেঁদেছিল পৃথিবীর বুক।
গোপনে নির্জনে
ধাবমান পুঞ্জ পুঞ্জ নক্ষত্রের কাছে
পেয়েছিল অতীত বারতা?
মেরুদণ্ড জীর্ণ তবু বিকৃত ব্যথায়
বার বার আর্তনাদ করে
আহত বিক্ষত দেহ, -মুমূর্ষু চঞ্চল,
তবুও বিরাম কোথা ব্যগ্র আঘাতের।
প্রথম পৃথিবী আজ জ্বলে রাত্রিদিন
আবাল্যের সঞ্চিক দাহনে
চিরদিন দ্বন্দ্ব চলে জোয়ার ভাঁটায়,
আষাঢ়ের ক্ষুব্ধ-ছায়া বসন্তের বুকে
এসে পড়েছিল একদিন-
উদ্ভ্রান্ত পৃথিবী তাই ছুটেছে পিছনে
আলোরে পশ্চাতে ফেলি, দুরে- বহু দূরে
যত দূরে দৃষ্টি যায় –
চেয়ে দেখি ঘিরেছে কুয়াশা।
উড়ন্ত বাতাসে আজ কুমেরু কঠিন
কোথা হতে নিয়ে এল জড় অন্ধকার,
-এই কি পৃথিবী?
একদিন জ্বলেছিল বুকের জ্বালায় –
আজ তার শব দেহ নিঃস্পন্দ অসাড়।।
উদ্যোগ
বন্ধু, তোমার ছাড়ো উদ্বেগ, সুতীক্ষ্ণ করো চিত্ত,
বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।
মূঢ় শত্রুকে হানো স্রোত রুখে, তন্দ্রাকে করো ছিন্ন,
একাগ্র দেশে শত্রুরা এসে হয়ে যাক নিশ্চিহ্ন।
ঘরে তোল ধান, বিপ্লবী প্রাণ প্রস্তুত রাখ কাস্তে,
গাও সারিগান, হাতিয়ারে শান দাও আজ উদয়াস্তে।
আজ দৃঢ় দাঁতে পুঞ্জিত হাতে প্রতিরোধ করো শক্ত,
প্রতি ঘাসে ঘাসে বিদ্যুৎ আসে জাগে সাড়া অব্যক্ত।
আজকে মজুর হতুড়ির সুর ক্রমশই করে দৃপ্ত,
আসে সংহতি; শত্রুর প্রতি ঘৃণা হয় নিক্ষিপ্ত।
ভীরু অন্যায় প্রাণ-বন্যায় জেনো আজ উচ্ছেদ্য,
বিপন্ন দেশে তাই নিঃশেষে ঢালো প্রাণ দুর্ভেদ্য!
সব প্রস্তুত যুদ্ধের দূত হানা দেয় পুব-দরজায়,
ফেনী ও আসামে, চট্টগ্রামে ক্ষিপ্ত জনতা গর্জায়।
বন্ধু, তোমারা ছাড়ো উদ্বেগ সুতীক্ষ্ণ করো চিত্ত,
বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।।
ঘুমভাঙার গান
মাথা তোল তুমি বিন্ধ্যাচল
মোছ উদ্গত অশ্রুজল
যে গেল সে গেল, ভেবে কি ফল?
ভোল ক্ষত!
তুমি প্রতারিত বিন্ধ্যাচল,
বোঝ নি ধূর্ত চতুর ছল,
হাসে যে আকাশচারীর দল,
অনাহত।
শোন অবনত বিন্ধ্যাচল,
তুমি নও ভীরু বিগত বল
কাঁপে অবাধ্য হৃদয়দল
অবিরত।
কঠিন, কঠোর বিন্ধ্যাচল,
অনেক ধৈর্যে আজো অটল
ভাঙো বিঘ্নকেঃ করো শিকল
পদাহত।
বিশাল, ব্যাপ্ত বিন্ধ্যাচল,
দেখ সূর্যের দর্পানল;
ভুলেছে তোমার দৃঢ় কবল
বাধা যত।
সময় যে হল বিন্ধ্যাচল,
ছেঁড় আকাশের উঁচু ত্রিপল
দ্রুত বিদ্রোহে হানো উপল
শত শত।।
জাগবার দিন আজ
জাগবার দিন আজ, দুর্দিন চুপি চুপি আসছে;
যাদের চোখেতে আজো স্বপ্নের ছায়া ছবি ভাসছে –
তাদেরই যে দুর্দিন পরিণামে আরো বেশী জানবে,
মৃত্যুর সঙ্গীন তাদেরই বুকেতে শেল হানবে।
আজকের দিন নয় কাব্যের –
আজকের সব কথা পরিণাম আর সম্ভাব্যের;
শরতের অবকাশে শোনা যায় আকাশের বাঁশরী,
কিন্তু বাঁশরী বৃথা, জমবে না আজ কোনো আসর-ই।
আকাশের প্রান্তে যে মৃত্যুর কালো পাখা বিস্তার –
মৃত্যু ঘরের কোণে, আজ আর নেই জেনো নিস্তার,
মৃত্যুর কথা আজ ভাবতেও পাও বুঝি কষ্ট
আজকের এই কথা জানি লাগবেই অস্পস্ট।
তবুও তোমার চাই চেতনা,
চেতনা থাকলে আজ দুর্দিন আশ্রয় পেত না,
আজকে রঙিন খেলা নিষ্ঠুর হাতে করো বর্জন,
আজকে যে প্রয়োজন প্রকৃত দেশপ্রেম অর্জন;
তাই এসো চেয়ে দেখি পৃথ্বী
কোনখানে ভাঙে আর কোনখানে গড়ে তার ভিত্তি
কোনখানে লাঞ্ছিত মানুষের প্রিয় ব্যক্তিত্ব,
কোনখানে দানবের ‘মরণ-যজ্ঞ’ চলে নিত্য ;
পণ করো, দৈত্যের অঙ্গে
হানবো বজ্রাঘাত, মিলবো সবাই এক সঙ্গে;
সংগ্রাম শুরু করো মুক্তির,
দিন নেই তর্ক ও যুক্তির।
আজকে শপথ করো সকলে
বাঁচাব আমার দেশ, যাবে না তা শত্রুর দখলে;
তাই আজ ফেলে দিয়ে তুলি আর লেখনী,
একতাবদ্ধ হও এখনি।।