- বইয়ের নামঃ সব কিছু ভেঙে পড়ে
- লেখকের নামঃ হুমায়ুন আজাদ
- প্রকাশনাঃ আগামী প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
আমি ব্রিজ বানাই
সব কিছু ভেঙে পড়ে – উপন্যাস – হুমায়ুন আজাদ
উৎসর্গ
যাদের আমি পাই নি
যারা আমাকে পায় নি
প্রথম প্রকাশ – ফাল্গুন ১৪০১ : ফেব্রুয়ারি ১৯৯৫
.
০১.
আমি ব্রিজ বানাই; বলতে পারতাম সেতু বানাই, তবে সেতু কথাটি, অন্যদের মতোই, সাধারণত আমিও বলি না, বলি ব্রিজ;–ব্রিজ বললেই ব্যাপারটি স্পষ্ট হয় আমার কাছে, চোখের সামনে ব্যাপারটি আর বস্তুটি দাঁড়ানো দেখতে পাই। সেতু বললে এখন আর কিছু দেখতে পাই না। বড়ো কয়েকটি ব্রিজ আমি বানিয়েছি, এখনও একটি বানাচ্ছি; কিন্তু সব সময় আমি ভয়ে থাকি ওই ব্রিজগুলো হয়তো এ-মুহূর্তেই ভয়ঙ্কর শব্দ করে ভেঙে পড়বে। তবে জানি এ-মুহূর্তে পড়বে না, যদিও পড়বে; ভবিষ্যতে ভেঙে পড়ার শব্দ এখনই আমি শুনতে পাই, দেখতে পাই তার দৃশ্যও। ছোটোবেলায় আমি একটি সাঁকো, বাঁশের পুল, নিয়ে ভেঙে পড়েছিলাম; আমার বানানো ব্রিজগুলোর পাশে সেটা কিছুই নয়, কিন্তু সব ব্রিজকেই আমার ওই সাঁকোটির মতো নড়োবড়ো মনে হয়। ব্রিজ একটি কাঠামো; সব কিছুই আমার কাছে কাঠামো;–বিশতলা টাওয়ার, জানালার গ্রিলে বৃষ্টির ফোঁটা, রাষ্ট্র, শিশিরবিন্দু, সভ্যতা, বুড়িগঙ্গার ব্রিজ, সমাজ, সংসার, বিবাহ, পনেরো বছরের বালিকা, তার বুক, দুপুরের গোলাপ, দীর্ঘশ্বাস, ধর্ম, আর একটি পর একটি মানুষ-পুরুষ, নারী, তরুণী, যুবকের সাথে আমার সম্পর্ক, অন্যদের সম্পর্ক, সব কিছুই আমার কাছে কাঠামো। কাঠামোর কাজ ভার বওয়া; যততদিন ভার বইতে পারে। ততোদিন তা টিকে থাকে; ভার বইতে না পারলে ভেঙে পড়ে। কোনো কাঠামোই চিরকাল ভার বইতে পারে না। কাঠামোগুলো যখন তৈরি করা হয়, তখন একটা ভারের হিশেব থাকে; কিন্তু দিন দিন ভার বাড়তে থাকে সেগুলোর ওপর, একদিন বাড়তি ভার আর সহ্য করা সম্ভব হয় না সেগুলোর পক্ষে। তখন ভেঙে পড়ে। সত্য হচ্ছে ভেঙে পড়া, কাঠামোর কাজ ওই ভেঙে পড়াকে, চরম সত্যকে, কিছু কালের জন্যে বিলম্বিত করা; কিন্তু একদিন সব কাঠামোই ভেঙে পড়বে। আমার পেশা ভেঙে পড়াকে একটা চমৎকার সময়ের জন্যে বিলম্বিত করা। আমার বন্ধু কলিমুল্লাহ কবিতা পছন্দ করে;–কবিতা একদিন আমিও পছন্দ করতাম–সেও ব্রিজ বানায়, কথায় কথায় সে বলে ব্রিজ হচ্ছে নদীর ওপর লোহার সঙ্গীত, বিম-পিয়ার-স্প্যানের লিরিক; তখন আমি সঙ্গীত আর লিরিকের কাঠামোর কথা ভেবেও ভয় পাই, সঙ্গীত ও লিরিকের প্রচণ্ডভাবে ধ্বংস হওয়ার শব্দ শুনতে পাই, ভেঙে পড়ার দৃশ্য দেখতে পাই।
ব্রিজ বানাতে বানাতে আমি চারদিকে ব্রিজ দেখতে পাই, ব্রিজ খুঁজি; কোনো মানুষকে দেখলেই তার ব্যক্তিগত ব্রিজের অবস্থা কী;–সে কার সাথে কেমন ব্রিজ দিয়ে নিজেকে যুক্ত করেছে, তার খালের বা নদীর এপার-ওপারের সম্পর্ক কী, তার কতোগুলো ব্রিজ নড়োবড়ো, কতোগুলো ব্রিজ ভেঙে পড়েছে, কতোগুলো সে আবার নতুনভাবে তৈরি করার চেষ্টা করছে, তা জানতে ইচ্ছে করে; তার মুখের দিকে তাকালে অনেক ধ্বংসপ্রাপ্ত ব্রিজের কাঠামো দেখতে পাই। তবে আমি কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করি না। প্রত্যেকেই এমন ভাব করে যে তার প্রত্যেকটি ব্রিজ চিরকাল ধরে ঠিক আছে, চিরকাল ধরে ঠিক থাকবে; কিন্তু আমি যেহেতু কাঠামো নিয়ে কাজ করি, কী উপাদান, কতোটা টেকসই, তা আমার মোটামুটি জানা, তাই তাদের ভান দেখে আমার দুঃখ হয়। আমার ব্রিজগুলোই কি আমি ঠিকমতো রাখতে পেরেছি? নদীর ওপর বানানো আমার ব্রিজগুলোর কোনোটি আজো ভেঙে পড়ে নি; কিন্তু সেগুলোর থেকেও শক্ত উপাদানে আমি যে-সব ব্যক্তিগত ব্রিজ বানিয়েছিলাম, তার অনেকগুলোই ধসে পড়েছে; যে-ব্রিজগুলো আমার জীবনকালে হয়তো ধসে পড়বে না, সেগুলোর বিমে ফাটল ধরেছে, স্তম্ভে ভয়ঙ্কর চাপ পড়ছে; সেগুলোকে আমি টিকিয়ে রাখতে পারবো না, যদিও সবাই চায় আমি ওগুলো টিকিয়ে রাখি; কিন্তু সেগুলো যে নিরর্থক হয়ে গেছে, তা আমি ভালো করেই জানি। আমার ওই ব্রিজগুলো আছে, কিন্তু সেগুলোর ওপর দিয়ে কোনো। চলাচল নেই; তাই ওগুলো থাকার কোনো অর্থ হয় না।
কিন্তু ব্রিজ, অর্থাৎ সাঁকো, আমার ভালো লাগে। খাল, নদী, পরিখা, পুকুর হচ্ছে বিচ্ছিন্নতা; ব্রিজ হচ্ছে সম্পর্ক ছেলেবেলায় সাঁকোর ওপর দিয়ে যাওয়ার জন্যে অনেক পথ ঘুরে আমি ইস্কুলে গেছি, মামাবাড়ি যাওয়ার সোজা পথে কোনো সাঁকো ছিলো না বলে সোজা পথ দিয়ে না গিয়ে আমি অনেক পথ ঘুরে গেছি, সে-পথ দিয়ে যাওয়ার সময় প্রথম একটি কাঠের সাঁকো পড়তো, তারপর অনেক দূর হাঁটার পর পড়তে একটা বড়ো লোহার পুল। মাঘ মাসেই কাঠের পুলটির নিচের খাল শুকিয়ে যেতো, সেখান দিয়ে একটা রাস্তা হতো; সবাই ওই রাস্তা দিয়েই যেতো, পুলটি দাঁড়িয়ে থাকতো। শুকনো কঙ্কালের মতো, তখন সেটি দেখে আমার কষ্ট হতো। আমি তখনও পুল দিয়েই যেতাম, যদিও যেতে আমার ভালো লাগতো না; যে-পুলের নিচে পানি নেই, তাকে পুল। মনে হতো না, তাই এক সময় আমিও পুলের নিচের রাস্তা দিয়েই যেতাম, পুলটির। দিকে তাকিয়ে কষ্ট পেতাম। লোহার পুলটি যে-দিন ভেঙে পড়লো, সেদিন আমার কষ্টের সীমা ছিলো না; ছেলেবেলায় যা কিছুকে আমার অবিনশ্বর মনে হতো, তার প্রথমেই ছিলো লোহার পুলটি;–অমন শক্ত কাঠামো তখন আমি আর দেখি নি, আমার বিশ্বাস ছিলো ওটা কখনো ভেঙে পড়বে না। লোহার পুলের কথা মনে হলেই আমার। বাবাকে মনে পড়ে, এখনও মনে পড়ছে; তার সম্পর্কে বড়ো হওয়ার পর আমি কিছু ভাবি নি, কিন্তু যখন কিশোর আমি তখন বাবাই ছিলেন আমার ভাবনার বড়ো বিষয়, ওই। লোহার পুলটির মতোই। বাবা দেখতে লোহার পুলটির মতোই বিরাট আর শক্ত ছিলেন; লুঙ্গি আর দামি পাঞ্জাবি পরতেন, হাঁটতেন সামনের দিকে একটু ঝুঁকে; কোথাও যাওয়ার। সময় তার পেছনে আমাদের শক্ত চাকরটা যেতো, তাছাড়া আরো দু-চারজন লোক তার দু-পাশে থাকতো সব সময়ই। বাবার পাশে লোকগুলোকে মানুষই মনে হতো না, নেড়ি কুকুরের মতো দেখাতো; তবে ওই লোকগুলোর মুখে আমি কোনো যন্ত্রণার ছাপ দেখতে পেতাম না, কিন্তু বাবার মুখে দেখতে পেতাম। ওই লোকগুলোর যন্ত্রণাবোধেরই শক্তিই সম্ভবত ছিলো না। রাবার সম্ভবত কোনো ব্রিজ ছিলো না; তাঁর কাছে যারা আসতো তারা এতো সামান্য ছিলো যে বাবার সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক হতেই পারে না। বাবার মুখের দিকে তাকালে আমি ব্রিজহীনতার কষ্ট দেখতে পেতাম। ছোটোবেলায়ই আমি। বুঝতে পেরেছিলাম আমরা প্রত্যেকেই খালের একপার,–খালের রূপকটিই আমার মনে হতো যেহেতু আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে একটি বড়ো খাল চলে গিয়েছিলো, তাই। অন্যপারের সাথে, অন্য কারো সাথে, অন্য অনেকের সাথে সাঁকো বাধা.দরকার; কিন্তু বাবা কোনো সাঁকো বাঁধতে পারেন নি।