- বইয়ের নামঃ রাজনীতিবিদগণ
- লেখকের নামঃ হুমায়ুন আজাদ
- প্রকাশনাঃ আগামী প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
আমরা হচ্ছি গরিব জনগণ’
রাজনীতিবিদগণ – উপন্যাস – হুমায়ুন আজাদ
উৎসর্গ – ওসমান গনি প্রীতিভাজনেষু
প্রথম প্রকাশ – ফাল্গুন ১৪০৪ : ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮
আমরা হচ্ছি গরিব জনগণ, সাধারণ মূর্খ মানুষ; আমরা রাজা বাদশা রাজনীতি প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতি এইসব জিনিশের কী বুঝি!
তবে আমাদেরও দুটি চোখ আছে, তাতে কিছু কিছু দেখি; আমাদেরও দুটি কান আছে, তাতে কিছু কিছু শুনি; আর দেখেশুনে মনে হয় দুনিয়াটা নানা রকম মালে ভরে গেছে, আর যে-সব মাল উত্তর থেকে দক্ষিণ পুব থেকে পশ্চিমে সবচেয়ে বেশি চলছে, তার মধ্যে এক নম্বর মাল হচ্ছে গণতন্ত্র; এর মতো আর কোনো মাল নেই; ধর্মকর্ম, হ্যাঁমবার্গার, প্রেম, ফিশ অ্যান্ড চিপস্, কাম, কোকাকোলা, বিয়ার, প্রিন্সেস ডায়না, আর রাবারও এতো জনপ্রিয় নয়। গণতন্ত্র এখন আমাদের পাগলি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মাল, এর জন্যে পৃথিবীখান অস্থির; উকুনশোভিত ভিখিরি আর শীততাপনিয়ন্ত্রিত কোটিপতি আর তারকাখচিত সেনাপতি সবাই দিনরাত মিছিল করে এখন গণতন্ত্র চান; তাই দিন নেই রাত নেই রাস্তা ঘাট পানশালা পতিতালয় ইস্কুল কলেজ মন্দির মসজিদ মুদির দোকান বিশতলা দালান, এবং আর যতো জায়গা আছে, সবখানেই চলছে গণতন্ত্রের বিষ্যুদ শুক্রবারহীন উৎপাদন। চারদিকে আমরা শুনছি গণতন্ত্র উৎপাদনের ঘটর ঘটর ঝকর ঝকর ভঝর ভঝর ভাঙর ভাঙর শব্দ। বদমাশ রাজাবাদশারা ছিলো এক কালে, বিংশ শতাব্দীর এই সভ্য সময়টা রাজাবাদশাদের নয়; তবে রাজাবাদশাদের ছাইপাঁশ আর পচাগলা মাংস থেকে উৎপন্ন হয়েছেন অসংখ্য অভিনব রাজা; তাদের আর রাজা বলি না আমরা, বিশেষ সম্মানের সাথে বলি রাজনীতিবিদ; তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আবার মহামান্য, মহামাননীয়, এবং তাদের স্ত্রীলিঙ্গরূপও পাওয়া যায়। তারা প্রেমময়, আমাদের অর্থাৎ জনগণের জন্যে তাঁদের প্রেম অনন্ত অসীম; জনগণের অর্থাৎ আমাদের জন্যে তাঁদের চোখে ঘুম নেই, তারা দুই চক্ষু বুজাইতে পারেন না; জনগণের কল্যাণের জন্যে এমন কাজকাম নেই (ইফতার, হজ, পাঁচতারা হোটেলে পার্টি, উমরা, মিছিল, যুক্তরাষ্ট্রভ্রমণ, ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন, হরতাল, নামাজ, রোজা, মদ্যপান, ঘুষ, হেলিকপ্টারে চড়ে বন্যার দৃশ্য দেখা, নির্বাচনের আগে ভিখিরির বাচ্চাকে জড়িয়ে ধরে চুমো খাওয়া তাদের জনকল্যাণমূলক ব্যাপক কর্মকাণ্ডের কয়েকটি মাত্র মনে এলো), যা তারা করেন না। সব ব্যবসার সেরা এই মহৎ দেশপ্রেম আর জনগণপ্রেমের ব্যবসা, যার নাম রাজনীতি; একটিমাত্র ব্যবসাই রয়েছে, যা শিখতে হয় না; জনগণের নামে রাস্তায় বেরিয়ে গেলেই হয়। রাজারা চলে গেলেও, তাদের বিদায় করে দেয়া হলেও তারা চলে যায় নি বলেই আমাদের, গরিব জনগণের, মনে হয়; মরা রাজাগুলো ভুতের মতো চেপে আছে।
আগে রাজবংশ ছিলো, কিন্তু এখন কি নেই? রাজবংশের এখন দরকার নেই? থাকবে না কেনো? থাকতে হবেই; গণতন্ত্রের জন্যেও রাজবংশ চাই আমাদের। আমরা, গরিব মানুষরা, আহাম্মকরা, যাদের কাজ নানান রঙের শ্লোগান দেয়া (শ্লোগান না দিলে বাচন কঠিন, শ্লোগান দিতে দিতে আমাদের গলা ফুলে ঢোল হয়ে গেছে), দেখতে পাই হঠাৎ কোনো আবদুল করিম মোল্লা বা কুদরত ব্যাপারী একটা রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। আমরাও প্রথম বুঝতে পারি না, আর তারাও বুঝতে পারেন না যে তাঁরা একটা রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। যখন বুঝতে পারি তখন আমাদের খুশির কোনো শেষ থাকে না, শুধু শ্লোগান দিতে থাকি।
আমরা যদি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হইতাম (হই নাই তাতে ভালই হইছে), তাহলে নিশ্চয়ই কতকগুলো সূত্র বের করে ফেলতাম; আর গণতান্ত্রিক রাজবংশ প্রতিষ্ঠার সূত্রগুলো হইতো এমন সরল :
প্রথম সূত্র
পিতা দীর্ঘকাল বিদেশি শাসকদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রাম করিবেন, স্বাধীনতার পর তিনি বহু বছর শাসন করিবেন, অন্য কোনো ব্যক্তি, দল বা রাজবংশকে দাঁড়াতে দেবেন না; তিনি মারা যাওয়ার পর তাঁর কন্যা বসিবেন গণতান্ত্রিক সিংহাসনে (পুত্রের বদলে কন্যা থাকলেই ভালো হয়)।
দ্বিতীয় সূত্র।
কোনো এক সেনাপতি এক ভোরবেলা দেশ দখল করে ফেলিবেন, তিনি একটি বিচারপতিকে ডাকবেন, বোকা বিচারপতিটি ভাববেন তিনি প্রেসিডেন্ট হয়েছেন; তারপর সেনাপতি দেশকে দিতে থাকবেন বুট সানগ্লাস লেফরাইট গণতন্ত্র, দেশের প্রখ্যাত সুবিধাবাদীরা (এই শব্দটি এখন প্রশংসা বোঝায়) জড়ো হতে থাকবেন তার বুট ঘিরে; একদিন তিনি অমর হয়ে যাবেন; তার গণতান্ত্রিক সিংহাসনে বসিবেন তার স্ত্রী (রূপসী হইলেই ভালো হয়)।
তৃতীয় সূত্র
দীর্ঘকাল রাজনীতি করে কেউ একজন মহান নেতা হয়ে উঠিবেন, জনগণ তাঁর কথায় উঠবে বসবে, জনগণের ৯৯%জন তার নামে পাগল থাকবে, ক্ষমতায় এসে তিনি ১০১টি বিশেষণ পরবেন তাঁর গণতান্ত্রিক মুকুটে, নতুন নতুন বিশেষণ আবিষ্কার করতে থাকবেন তাঁর ভক্তরা, এবং জনগণের ১০%জনও তাকে আর সমর্থন করবে না, তিনিও একদিন অমর হয়ে যাবেন; তাঁর কন্যা দেশে দেশে উদ্বাস্তুর মতো ঘুরে একদিন দেশে ফিরে আসবেন, বসিবেন পিতার সিংহাসনে (একটু সময় লাগিবে)।
চমৎকার খুব ভাল লাগলো