- বইয়ের নামঃ মানবজমিন
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ জ্যোৎস্না পাবলিশার্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. পুতুলরাণী হাপিস হয়ে যাওয়াতে
পুতুলরাণী হাপিস হয়ে যাওয়াতেই হাফ-খরচা হয়ে গেল নিতাই। কৌপিন ধরল, জটা রাখল। কপালে মস্ত সিঁদুরের টিপ। লোকে নাম দিল খ্যাপা নিতাই।
খ্যাপা নিতাই এখন ওই বসে আছে শিমুল গাছের তলায়। রক্তাম্বরের কোঁচড়ে পো-দেড়েক মুড়ি। সকাল থেকেই আজ রোদ আর বাতাসের বড় বাড়াবাড়ি। উত্তরে হাউড় বাতাস এসে কলকল করে কথা বলছে গাছের পাতার সঙ্গে, মাঝে মাঝে টানা দীর্ঘশ্বাস তুলে যাচ্ছে ডালপালায়। খসিয়ে দিয়ে যাচ্ছে শালের শুকনো পাতা। নিতাইয়ের চারদিকে থিরিক থিরিক নেচে নেচে কয়েকটা শালিখ আর কাক অনেকক্ষণ ধরে মুড়ির ভাগা চাইছে। এক মুঠ মুড়ি মুখে ফেলতে গিয়ে হঠাৎ একটা ভাবনা এল মাথায়। সামনেই শালার হ্যাট মাথায় সাইকেলে ঠেসান দিয়ে দাঁড়িয়ে মদন ঠিকাদার নতুন রাস্তা তৈরির কাজ তদারক করছে। দুরমুশ করা মাটির ওপর ইট সাজানো শেষ হয়েছে। এখন ঝুড়ি ঝুড়ি পাথরকুচি ঢালছে কামিনরা।
নিতাই ভাবল, শালারা করছেটা কী? তার হাঁ করা মুখের দরজায় কোষভরা মুড়ি থেমে ছিল অসাবধানে, অন্যমনস্কতায়। পাজি বাতাস এসে এক থাবায় বারো আনা মুড়ি উড়িয়ে নিয়ে ছড়িয়ে ফেলল চারদিকে। নিতাই বেকুবের মতো চেয়ে কাণ্ডটা দেখল, তারপর মুঠোভর যেটুকু মুড়ি ছিল তাও উড়িয়ে দিয়ে বলল, খা শালারা পঞ্চভূত!
বাকি মুড়ি কোমরে বেঁধে উঠে গেল নিতাই। সামনের গড়ানে জমি ধরে নেমে গিয়ে মদনের দু-তিন হাত পিছনে দাঁড়িয়ে পড়ল। কোমরে হাত রেখে মাতব্বরের মতো উত্তর-দক্ষিণে টানা নতুন রাস্তাটার ঘেয়ো চেহারা দেখল। অবশ্য কাজ শেষ হলে এতটা ঘেয়ো দেখাবে না। তখন গাড়ি যাবে, মানুষ, গোরু, কুকুর হাঁটবে। গলা খাঁকারি দিয়ে সে খুব নরম গলায় বলল, মদনবাবু, এই এত এত রাস্তা তৈরি করা কি ভাল হচ্ছে?
মদন ঠিকাদার আলকাতরার মতো কালো, লম্বা। মস্ত গোঁফ আছে তার। ভীষণ রাগী চেহারা। একবার ফিরে তাকাল মাত্র। চোখে আগুন।
নিতাই তাতে ভয় খায় না। সেও সাধক, তান্ত্রিক। বলল, দুনিয়াময় যদি রাস্তাই বানায় মানুষ, কেবল বাড়িঘর বানিয়ে বানিয়েই যদি জায়গা ভরাট করে, তবে চাষবাসইবা হবে কোথায়, মানুষ খাবেই বা কী? কথাটা ভেবে দেখবেন একটু? আমি ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছি, একেবারে মুখ নই।
মদন একটি কথাও বাজে খরচ করে না। ভারী গম্ভীর মানুষ। যারা কম কথা বলে, যারা প্রয়োজনের চেয়েও কম কথা বলে তাদের লোকে কী জানি কেন একটু ভয় পায়। মদন কখনও কাউকে মারেনি ধরেনি, গালাগালও করেনি বড় একটা, তবু কুলি কামিন থেকে বন্ধুলোক পর্যন্ত তাকে একটু খাতির দেখিয়ে চলে। খ্যাপা নিতাইয়ের কথারও কোনও জবাব দেয় না মদন। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আবার কাজ দেখতে থাকে।
মদন জবাব না দিল তো বয়েই গেল নিতাইয়ের। কিন্তু সাহস করে একটা মস্ত তত্ত্বকথা যে মদন ঠিকাদারকে বলতে পেরেছে সে তাতেই ভারী খুশি হল। ফের ঢিবির ওপর উঠে শিমুলের ছায়ায় জমিয়ে বসল সে। একটা কাকের দিকে চেয়ে বলল, নিতাই কাউকে উচিত কথা বলতে ছাড়ে না, হ্যাঁ।
আজ সকালে খুব ঘন কুয়াশা ছিল। শেষ রাত থেকে বাঁদুরে টুপি আর তুষের চাদরে জাম্বুবান সেজে দক্ষিণের টানা বারান্দায় কাঠের ভারী চেয়ারখানায় বসে আছে শ্রীনাথ। তার চোখের সামনেই কুয়াশার আড়ালে রোগা-ভোগা ন্যাড়া মাথা কমজোরি সূর্যেব উদয় হল। তারপর অবশ্য কুয়াশা কেটে ঝা ঝা রোদ ফুটেছে। শ্রীনাথ টুপি আর চাদর খুলে ফেলেছে অনেকক্ষণ। বাগানে উবু হয়ে বসে বসে এ গাছ সে গাছের পায়ে ধরে, গায়ে হাত বুলিয়ে বাবা-বাছা বলে সেবা দিচ্ছে। রোদের তাপে আর পরিশ্রমে গেঞ্জি ভিজে ঘাম ফুটে উঠল। ফর্সা রং এখন টমেটোর মতো টুকটুকে। কনুই পর্যন্ত মাটি মাখা, সারা মুখে ধুলোবালি। শেষ শীতে পালঙের শিষ হঠাৎ লাফিয়ে ঢ্যাঙা হয়ে উঠেছে হাত দেড়েক। তারই আড়াল থেকে দেখতে পেল, বারান্দার সামনের দিকে কোণে একটা সাদা কাপ ডিশ দিয়ে ঢেকে রেখে গেছে কে যেন। দু হাতে তালি বাজিয়ে মাটি ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে আসে শ্রীনাথ। বারান্দার নীচে চায়ের কাপটার তলাতেই একটা মস্ত গো-হাড় কামড়াচ্ছে খ্যাপা নিতাইয়ের কুকুর ইস্পাত। ব্যাটা চায়ের কাপটা শুঁকেটুকে দেখেনি তো! চা রেখে গেছে, কিন্তু তাকে ডেকে দিয়ে যায়নি। শ্রীনাথ চায়ের কাঁপে জ্বর দেখার মতো হাত ছুঁইয়ে দেখল, নিমঠান্ডা। এর চেয়ে বেশি এ বাড়ির লোকের কাছে সে আশাও করে না। আস্তে আস্তে ঠান্ডা চা-ই খেয়ে নেয় শ্রীনাথ। অভিমান বা রাগ করে লাভ নেই। বউ, মেয়ে, ছেলে, এরা সবাই তার আপনজনই তো। আদরযত্ন করার ইচ্ছে থাকলে এমনিতেই করত। এখন এই বিয়াল্লিশ বছর বয়সে সে কিছুই আর নতুন করে ঢেলে সাজাতে পারবে না।
নিতাইয়ের কুকুরটা কুঁই কুঁই করে এখন তার পায়ের ফাঁকে মুখ গুঁজে আদর কাড়বার চেষ্টা করছে। গো-হাড় চিবোচ্ছিল, ঘেন্নায় পা তুলে বসে শ্রীনাথ। কিন্তু নেই-আঁকড়া কুকুরটা কি তাতে ছাড়ে? শ্ৰীনাথ বলল, হাড়টা তো এনে ফেলেছ বাপ, কিন্তু আবার যে সেটা বাইরে গিয়ে রেখে আসবে সে বুদ্ধি নেই। সাধে কি কুকুর বলেছে!
ফটক ঠেলে বদ্রী ঢুকল। গায়ে জহর কোট, পাজামা, হাতে ফোলিও ব্যাগ, চতুর গোঁফ। সোজা এসে রোদে-তাতা বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসল। ব্যাগ খুলে কাগজপত্র বের করতে করতে বলল, প্রমথবাবুর জমিতে বর্গা রেজিস্ট্রি হয়ে আছে। ওঠানো যাবে না। তবে বর্গার দরুন দাম কিছু ছাড়তে রাজি আছেন।