- বইয়ের নামঃ ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল
- লেখকের নামঃ হুমায়ুন আজাদ
- প্রকাশনাঃ আগামী প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল – উপন্যাস – হুমায়ুন আজাদ
উৎসর্গ
পরলোকগত পিতা
আমি একটি নাম খুঁজছিলাম
আপনার নামটিই–রাশেদ—মনে পড়লো আমার
প্রথম প্রকাশ – ফাল্গুন ১৪০০ : ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪
শেষরাতে বিপ্লব এবং গুবরেপোকার দল
উৎসর্গ
পরলোকগত পিতা
আমি একটি নাম খুঁজছিলাম
আপনার নামটিই–রাশেদ—মনে পড়লো আমার
প্রথম প্রকাশ – ফাল্গুন ১৪০০ : ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪
১ শেষরাতে বিপ্লব এবং গুবরেপোকার দল
রাইফেলের নির্দেশে তুমি ফোঁটাচ্ছো
সামরিক পদ্ম, সাইরেনে কেঁপে নামাচ্ছো
বর্ষণ, নাচছো বৃষ্টিতে চাবুকের শব্দে, এক ম্যাগজিন–
ভর্তি হলদে বুলেট পাছায় ঢুকলে তুমি জন্ম দাও নক্ষত্রস্তবকের
মতো কাঁপাকাঁপা একটা ধানের শীষ। প্রকাশ্য রাস্তায় তুমি একটা লজ্জিত রিকশা ও
দুটো চন্দনা পাখির সামনে একটা রাইফেল-একজোড়া বুট-তিনটা শিরস্ত্রাণের সঙ্গে
সঙ্গম সারো;–এজন্যেই কি আমি অনেক শতাব্দী ধরে স্বপ্নবস্তুর
ভেতর দিয়ে ছুটে-ছুটে পাঁচশো দেয়াল-জ্যোৎস্না-রাত্রি–
ঝরাপাতা নিমেষে পেরিয়ে বলেছি, ‘রূপসী, তুমি,
আমাকে করো তোমার হাতের গোলাপ।’
.
মাঝেমাঝে কালঘুমে পায় রাশেদকে;–সে ঘুমিয়ে পড়ে যেনো মরে গেছে বা তার জন্মই হয় নি, যেনো মানুষ, সমাজ, সংঘ, বা পৃথিবীর কেউ সে নয়, যেনো সে ট্রাউজার বা পাজামা বা লুঙ্গিপরা বা নগ্ন মানুষদের, বা দেয়ালঘেরা দালান বা মানচিত্রিত রাষ্ট্রের কেউ ছিল না কখনো, ভবিষ্যতেও এদের কেউ থাকবে না; আর তখন তার চারপাশে, ঘুমভাঙা মানুষের জগতে, ঘটে যায় বড়ো কোনো ঘটনা, যাকে অনেক সময় ইতিহাস বলা হয়। তার ছেলেবেলায় প্রথম ঘটে এমন এক ঘটনা, যা আজো সে মনে করতে পারে, এবং কখনো ভুলবে না; হয়তো তারও আগে, যখন সে মায়ের বুকে তৃতীয় স্তনের মতোই লেগে থাকতো, তখনো ঘটেছে এমন ঘটনা, তবে তা সে আর মনে করতে পারে না। রাশেদ, তখন ছোটো ও একমুঠো, মসজিদের পাশের নানা রঙের কবরঘেরা ভীতিকরভাবে আকর্ষণীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়টিতে যেতে শুরু করেছে; তখন ঘটে আজকের মতোই এক ঘটনা, সেদিনও সে ঘুমিয়ে ছিলো যেনো তার জন্ম হয় নি, কখনো জন্ম হবে না। সে-রাতে আগুন লেগেছিলো পাশের বাড়িতে, চোতবোশেখে। চাষীদের বাড়িতে কুপি উল্টে বা চুলো থেকে বেড়ার খড় বেয়ে শিখা উঠে প্রায়ই যেমন আগুন লাগে। ওই আগুনে রাত দিনের মতো কড়কড়ে হয়ে উঠেছিলো, পুবপশ্চিম পাড়া থেকে মানুষ ছুটে এসেছিলো বালতি হাতে, যাদের অনেকে পানি ছিটানোর থেকে চিৎকারই করেছিলো বেশি, কেউ কেউ আগুনের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলো যেনো অন্ধ, সে-লকলকে অগ্নিকাণ্ডের সামান্য শব্দও তার কানে ঢোকে নি। পুবপুকুরের কাদামাটির মতো সে ঘুমিয়ে ছিলো। মা তার পাশে সারাক্ষণ বসে ছিলো, যদি আগুন তাদের বাড়ির দিকেও জিভ বাড়িয়ে দেয়, তাহলে রাশেদকে কোলে করে যাতে উত্তরের পুকুরের পানি ভেঙে মাঠের দিকে যেতে পারে। মা রাশেদের ঘুম ভাঙায় নি, বরং সুখ পাচ্ছিলো একথা ভেবে যে তার শিশুপুত্র আগুনের খুব কাছাকাছি থেকেও অনেক দূরে থাকতে পারে।
আজকের চোতের রাতটিতেও ছেলেবেলার সে-রাতের মতোই ঘুমিয়ে ছিলো। রাশেদ, কিছুই টের পায় নি, তার ঘুমের ভেতরে কোনো বাস্তবতা আক্রমণ চালায় নি; যেমন একাত্তরের মার্চের বিভীষিকার রাতটিতেও সে আঠালো কাদার মতো ঘুমিয়ে। ছিলো। ঘুমকাতুরে সে নয়, ঘুমের মধ্যে কেউ তাকে ঠেলা দিলে প্রথমবারেই সে জেগে ওঠে, খুব স্বাভাবিকভাবে ঢোকে মানুষের জগতে; কিন্তু বড়ো বড়ো ঘটনার রাতে, যে-রাতে মানুষ বা প্রকৃতি বাস্তবায়িত করে কোনো চক্রান্ত, রাশেদ মানুষ ও প্রকৃতির সীমা পেরিয়ে ঢুকে পড়ে জন্মের আগের অন্ধকারে। পঁচিশে মার্চের রাতে সে ঘুমোতে গিয়েছিলো সাড়ে দশটার দিকে; তার আগে সারাদিন এক বন্ধুর সাথে ঢাকা ভরে হেঁটেছে, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রামের অর্থ কী, তাতে রয়েছে কতোখানি ধাঁধা আর কতোখানি বস্তু, বের করার চেষ্টা করেছে; কেননা মুজিব-ইয়াহিয়ার নিরর্থক সংলাপ হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেছে অথচ জনগণকে কিছু জানানো হয় নি, তর্ক করেছে এসব নিয়ে; সন্ধ্যের বেশ পরে বাসায় ফেরার সময় দেয়াল ভেঙে, গাছের গুঁড়ি, ইটপাটকেল জড়ো করে পাড়ার ছেলেদের পথ আটকাতে দেখেছে, মিলিটারি এলে এসব দিয়ে কততক্ষণ ঠেকানো যাবে, তা জানতে চেয়েছে দুর্দান্ত ছেলেদের কাছে, এবং রাত ভরে একটি স্বায়ত্তশাসিত বঙ্গীয় ঘুমের পর ভোরে জেগে উঠে মাকে জিজ্ঞেস করেছে, পুব দিকের আকাশে এতো ধুয়ো কেননা?
বসন্ত, অনেক দিন ধরে, এ-ধরনের একটি কবিতার পংক্তি পড়ার অনেক আগে। থেকেই, রাশেদের মনে হয়, খুব নিষ্ঠুর কাল। জংধরা পেরেকের মতো ডাল ফেড়ে যখন তলোয়ারের মতো সবুজ পাতা গজায়, লাল হলুদ হয়ে ওঠে ভিখিরির মতো গরিব গাছ, চারপাশে রাশেদ শুনতে পায় কাতর আর্তনাদ। নিষ্ঠুর বসন্ত আবার এসেছে, শেষ হয়ে এসেছে মার্চ, এবং কালঘুমে পেয়েছে রাশেদকে। গতরাতেও পাশের বাড়ির কাজের। মেয়েটির চিৎকারে সবার আগে তার ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো, মেয়েটি দ্বিতীয় চিৎকার দেয় নি বলে সে আবার চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়েছিলো, কিন্তু আজ রাশেদ জ্বণে পরিণত হয়েছিলো, সকাল আটটা বাজার পরও ওঠে নি। সে চোখ খুললো যখন মৃদু তাকে ‘আব্বু’ বলে ডাকলো। চোখ খুলেই সে দেখলো মৃদু তার বিছানার পাশে জলের। ফোঁটার মতো টলমল করছে;-তার গায়ে ইস্কুলের পোশাক, কী চমৎকার পাখির ডানার মতো তার ঝুঁটি, একখনি উড়ে গিয়ে হয়তো বসবে কোনো পেয়ারা গাছে, কিন্তু সে। এমন টলমল করছে যেনো এখনি ঝরে যাবে। রাশেদের মনে হলো সে হয়তো কোনো মারাত্মক অপরাধ করে ফেলেছে মৃদুর কাছে। এভাবেই কোনো শেষ নেই তার। অপরাধের, মানুষ পাখি গাছপালা পোকামাকড় বাতাস মেঘ বিদ্যুৎ ঘাস খড়কুটো শ্যাওলা কলকজার কাছে সে এতো অপরাধ করেছে যে মৃদুর জন্মের সময়ই, ক্লিনিকের বারান্দায় দাঁড়িয়ে, সে প্রতিজ্ঞা করেছিলো এ-অভিনব মানুষটির কাছে কখনো কোনো। অপরাধ করবে না। মৃদু গলে পড়ার আগেই রাশেদ মৃদুকে জড়িয়ে ধরে বললো, কী হয়েছে মৃদু? কে তোমাকে কষ্ট দিয়েছে? মৃদু বললো, ওরা আমাকে ইস্কুলে যেতে দিলো কেনো? রাশেদ কিছুটা ভয় পেয়ে জোরে জিজ্ঞেস করলো, কারা? মৃদু বললো, মিলিটারিরা।