- বইয়ের নামঃ পদক্ষেপ
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ দে’জ পাবলিশিং (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. আপনি একজন বড় স্কলার
আপনি একজন বড় স্কলার, তাই না?
এসব কথা থাক। একগাদা ডিগ্রি কোনও কাজে লাগে না।
কিন্তু এ ব্যাপারটাকে আমি বিশেষ গুরুত্ব সহকারে দেখছি।
কেন দেখছেন? ডিগ্রি দিয়ে কিছু হয় না।
আপনি মাধ্যমিকে প্রথম কুড়িজনের মধ্যে ছিলেন। সাধারণত এই পর্যায়ের রেজাল্ট যারা করে তারা সায়েন্স নিয়ে পড়ে এবং ডাক্তারি বা প্রযুক্তির লাইনে যায়, আপনি তা যাননি। আপনি আর্টস পড়েছেন। কেন বলুন তো?
আমার কলকবজার ব্যাপারও ভাল লাগত না, ডাক্তারিতেও আগ্রহ ছিল না। ইতিহাসে আমার খুব ইন্টারেস্ট ছিল বরাবরই। ইতিহাসে আমি সবসময়ই ভাল নম্বর পেতাম।
ভাল কথা। সবাই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হোক এটা কাম্যও নয়। বিশেষ করে এখন ইঞ্জিনিয়ারদের বাজার পড়তির দিকে। গত কয়েক দশকে নানা ধরনের ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে বহু ছাত্র পাশ করে বেরোনোর ফলে চাকরিতে টান পড়েছে। বিদেশেও তাদের ছাঁটাইয়ের মুখে পড়তে হচ্ছে। ডাক্তারদের অবস্থা হয়তো একটু বেটার। কিন্তু নাম না করলে ডাক্তারদের পশার নেই।
আপনি প্রফেশনের কথা ভাবছেন তো! আমি যখন লেখাপড়া করতাম তখন পেশা নিয়ে কিছু ভাবিনি। পড়াশুনো করতাম নেশার মতো। তবে আমি জানতাম ইতিহাস পড়ে খুব মোটা মাইনের চাকরি পাওয়ার আশা নেই, বড়জোর একটা অধ্যাপনা।
শেষ পর্যন্ত আপনি তাই পেয়েছেন, এতে কি আপনি খুশি?
হ্যাঁ, অখুশি হওয়ার কী আছে বলুন। আমি তো স্বেচ্ছায় আমার বিষয় নির্বাচন করেছি। ভবিষ্যৎ জানাই ছিল।
আপনি তো ল-ও পড়েছেন। যতদূর জানি এলএলবি-তেও আপনি ভালই ফল করেছিলেন।
হ্যাঁ। আমাদের সম্পত্তিঘটিত একটা দীর্ঘস্থায়ী মামলা ছিল। আমরা উকিলের আর আদালতের পিছনে অনেক খরচ করেছি। বাবা আমাকে ল পড়তে বলেন ওই মামলা চালানোর জন্যই।
মামলা কি আপনি চালিয়েছেন?
খানিকটা সাহায্য করেছিলাম বইকী!
মামলাটা আপনারা শেষ পর্যন্ত জিতেও যান।
হ্যাঁ।
তা হলে আপনি ওকালতিও খারাপ করতেন না।
করলে হয়তো ভালই করতাম। কিন্তু আপনাকে তো বলেছি, আমার ওসব ভাল লাগে না। আমি লেখাপড়া নিয়ে থাকতে ভালবাসি। আর আমার প্রিয় বিষয় হল ইতিহাস। কিন্তু আপনি যে কেসটার তদন্ত করছেন তাতে আমার কোয়ালিফিকেশন কোন প্রসঙ্গে আসছে?
নিরুপমবাবু, আমার কাছে যে তথ্যপ্রমাণ আছে তাতে দেখা যাচ্ছে ইতিহাস আপনার প্রিয় বিষয় হলেও অনার্সে আপনি খুব টেনেমেনে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিলেন। আর এমএ-তে তাও নয়, সেকেন্ড ক্লাস ফাস্ট।
আপনার তথ্য ভুল নয়, ও দুই পরীক্ষাই আমার খারাপ হয়েছিল। অনার্সের আগে আমি চোখের একটা অসুখে পড়েছিলাম, ডাক্তার সন্দেহ করেছিল রেটিনা ডিট্যাচমেন্ট, শেষ অবধি অবশ্য তা হয়নি। এমএ পরীক্ষার আগে আমি একটি মেয়ের পাল্লায় পড়ে খানিকটা গোল্লায় গিয়েছিলাম।
মেয়েটির নাম কি স্বপ্না?
আপনি কী করে জানলেন?
জানাই যে আমার কাজ।
তাই দেখছি। আর কিছু জানতে চান?
হ্যাঁ। আমার অনেক কিছু জানার আছে। স্বপ্না সেন সম্পর্কে যদি একটু ডিটেলস ইনফর্মেশন দিতে পারেন তা হলে ভাল হয়।
স্বপ্না! সে তো অতীত, তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল প্রায় দশ-বারো বছর আগে। তখন আমার বোধহয় বাইশ-তেইশ বছর বয়স। কিংবা আরও একটু কম হতে পারে। এমএ ফার্স্ট ইয়ারে আমার বয়স বোধহয় ছিল একুশ।
হ্যাঁ, তাই ছিল।
স্বপ্নার সঙ্গে তখন আমার একটা রোমান্টিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। স্বপ্না খুবই সুন্দরী ছিল। একটা মিষ্টি ঝগড়ার ভিতর দিয়ে আমাদের ভাব হয়। সেটা দ্রুত ঘনিষ্ঠতর সম্পর্কে পরিণত হয়।
ঝগড়াটা কী নিয়ে হয়েছিল?
ছেলেমানুষি ব্যাপার। অবশ্য তখন আমরা তো ছেলেমানুষই ছিলাম। আমাদের একটা প্রাচীর পত্রিকা বেরোত। পবিত্র সেন নামে একটি ছেলে হাতে লিখে পনেরো দিন পর পর সেটা আমাদের ক্লাসরুমের করিডরের দেয়ালে ঝুলিয়ে দিত! সেটা সবাই খুব ইন্টারেস্ট নিয়ে পড়তও। তাতে আমি স্বপ্ন নামে একটা কবিতা লিখেছিলাম। স্বপ্না সেটা পড়ে ভীষণ চটে যায়। তার ধারণা হয়েছিল ওটা ওকে নিয়ে লেখা এবং তাই নিয়ে ঝগড়া। রেগে গিয়ে স্বপ্না অধ্যাপকের কাছেও নালিশ করেছিল। যাই হোক, শেষ অবধি মিটমাট হয় এবং ভাবও হয়।
তারপর?
তারপর যা হয় আর কী। কফি হাউস, ময়দান, সিনেমা আর থিয়েটার, আর্ট এগজিবিশন এইসব করে বেড়াতাম দুজনে।
কোনও ফিজিক্যাল সম্পর্ক?
আরে না মশাই, না, দশ-বারো বছর আগে আমাদের নীতিবোধ খানিকটা অবশিষ্ট ছিল। আর আমার মনে হয়, স্বপ্না কোনওদিনই আমাকে সিরিয়াসলি নেয়নি, বড়লোকের মেয়ে এবং বেশ বুদ্ধিমতী, সে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল যে আমি হচ্ছি তার স্টপ গ্যাপ কম্প্যানিয়ন। যথারীতি এমএ পরীক্ষার পরেই সে দুঃখপ্রকাশ করে ভোকাট্টা হয়ে যায়। এখন সে সুইজারল্যান্ডে এক সফল একজিকিউটিভের ঘর করছে। আর সেই প্রেম থেকে বুরবক আমি লাভ করলাম একটা সেকেন্ড ক্লাস এবং খানিকটা তিক্ততা। কিন্তু আপনার তদন্তে স্বপ্নাকে কেন প্রয়োজন হচ্ছে সেটাই আমি বুঝতে পারছি না।
হয়তো পরে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে, আপাতত আমি আপনাকে এরকম কিছু কিছু প্রশ্ন করেই যাব।