- বইয়ের নামঃ কালো বেড়াল, সাদা বেড়াল
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১-০৫. ইন্টারকমে অতনুর গলা
ইন্টারকমে অতনুর গলা পাওয়া গেল, স্যার, একজন পুলিশের লোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন।
মনোজ সেন খুবই অবাক হয়ে বলল, পুলিশের লোক? পুলিশের লোক আমার কাছে কী চায়?
সেটা উনি আপনাকেই বলতে চান।
আজ আমার সময় কোথায়? এখনই ফরেন ডেলিগেটরা এসে পড়বেন। একটু আগে তাজ বেঙ্গল থেকে ওঁরা বেরিয়ে পড়েছেন। মিনিস্টারের সঙ্গে জাস্ট পনেরো মিনিটের অ্যাপয়েন্টমেন্ট সেরেই চলে আসবেন। আমি কতটা ব্যস্ত বুঝতে পারছ? আই অ্যাম গোয়িং থ্রু দি পেপার্স নাউ। লাস্ট মিনিট চেকিং।
সবই বলেছি স্যার। তবু উনি ইনসিস্ট করছেন।
ওঁকে ফোনটা দাও।
ও-কে স্যার।
টেলিফোনে একটা মিহি গলা পাওয়া গেল যা মোটেই পুলিশি কর্তৃত্বব্যঞ্জক নয়। বরং খুবই ভদ্র ও বিনয়ী গলা, মিস্টার সেন, আমার প্রয়োজনটা বিশেষ জরুরি।
আপনি আগামী কাল আসুন।
আমি জানি আপনি আজ ফরেন ডেলিগেটদের নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন। আজ তাদের সঙ্গে আপনার লাঞ্চ এবং মিটিং। একটা কন্ট্রাক্টও আজ সই হবে। কিন্তু আমার দরকারটাও গুরুতর।
খুবই মুশকিলে ফেললেন। এনিওয়ে, দু’মিনিটের বেশি সময় নেবেন না। বাই দি বাই, আপনি কি লালবাজারের লোক?
না।
তা হলে কি লোকাল থানা?
না। আমার হেড কোয়ার্টার প্যারিসে।
বলেন কী? ফরাসি পুলিশ কি বাংলা বলে?
বলে। যদি ইন্টারপোলের লোক হয়। আমি বাঙালি। দুর্ভাগ্যবশত।
ইন্টারপোল? সে তো সাংঘাতিক ব্যাপার। আসুন মশাই।
তার সেক্রেটারি সোনালি সোম চুক্তিপত্রের কাগজগুলো টেবিলে খুব সুন্দরভাবে সাজিয়ে দিচ্ছিল। মনোজ সেন তার দিকে চেয়ে বলল, ইন্টারপোলের কে একজন দেখা করতে চাইছে।
ঠিক আছে স্যার, আমি পরে আসছি।
কাগজগুলো চটপট ফাইলবন্দি করে সোনালি পাশের সুইংডোর ঠেলে ও ঘরে চলে গেল। যেতে না যেতেই বেয়ারা সামনের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে স্লিপ রাখল টেবিলে।
মনোজ সেন স্লিপটা নিয়ে নামটা দেখল। সুধাকর দত্ত। ইন্টারপোল।
ভিতরে নিয়ে এসো।
যে লোকটা ঘরে ঢুকল তার চেহারাটা বেশ ভাল। তাকতওয়ালা লোক। লম্বাই চওড়াই আছে। নেভি ব্লু সুট পরা। গলায় বো। বয়স ত্রিশের কাছেপিঠে।
নমস্কার।
নমস্কার, বসুন।
আপনি আজ খুবই ব্যস্ত আমি জানি সেনসাহেব। ডিস্টার্ব করলাম বলে ক্ষমা করবেন।
ঠিক আছে, ঠিক আছে। বলুন কী করতে পারি।
আমার বক্তব্য খুব সংক্ষেপে বলা যাবে না। ইটস এ লং স্টোরি।
কিন্তু
কিন্তু আজ আপনার হাতে সময় নেই। ইন ফ্যাক্ট আমার হাতেও নেই। সেইজন্য শুধু কাজের কথাটুকু বলে নিই। কেমন?
সেই ভাল।
আমি আসছি এখন পশ্চিম এশিয়া থেকে।
এই যে বললেন প্যারিস?
হ্যাঁ। আমার হেড কোয়ার্টার প্যারিসে। কিন্তু আমি অন ডিউটি একটা অ্যাসাইনমেন্টে আছি।
বুঝেছি। বলুন।
আপনার কোম্পানি একটা বড় কন্ট্রাক্ট পাচ্ছে, তাই না?
হ্যাঁ।
মোট বারোজন ডেলিগেট এসেছেন, সবাই সরকারি প্রতিনিধি?
হ্যাঁ।
আপনি ক’দিন আগে ওখানে গিয়েছিলেন?
মাস আটেক আগে।
এঁদের সবাইকে কি আপনি চেনেন?
না। তবে কারও কারও সঙ্গে দেখা হয়েছিল। দু’-তিনজনকে চিনি।
এই বারোজনের মধ্যে একজনকে আমার দরকার।
তার মানে?
তিনি একজন ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিন্যাল।
বলেন কী?
ভয় পাবেন না। আমি তাকে অ্যারেস্ট করব না, কোনও ঝঞ্ঝাট ঝামেলাও হবে না। আমি তাকে জাস্ট আইডেন্টিফাই করতে চাইছি।
তার মানে কি আপনি তাকে চেনেন না?
না। তবে এই বারোজনের মধ্যে একজন তিনি।
কিন্তু এরা সবাই সরকারি প্রতিনিধি। প্রত্যেকেই সরকারের দায়িত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। আপনার কি মনে হয় কোনও সরকার একজন ক্রিমিন্যালকে গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখবেন?
দুটো কারণে রাখতেই পারেন। এক, সরকার সম্ভবত জানে না যে ইনি একজন ক্রিমিন্যাল। দুই, ইনি হয়তো একজন এমন বিশেষজ্ঞ যে, সরকারের পক্ষে এঁকে তাড়ানো সম্ভব নয়। তৃতীয় আর একটা কারণও আছে। ইনি হয়তো সরকারকে ব্ল্যাকমেল করেছেন বা এঁর খুঁটির জোর আছে।
আইডেন্টিফাই করলে কী করবেন?
আমার কাজ আইডেন্টিফাই করা এবং হেড কোয়ার্টারে জানানো।
তারপর?
ডেলিগেটরা এরপর মায়ানমার এবং থাইল্যান্ড যাবেন। তারপর দেশে ফিরবেন। সম্ভবত আমাকেও ওঁদের পিছুপিছু যেতে হবে।
আমাকে কী করতে বলছেন?
আপনার কাছে আমার একটি প্রার্থনা আছে। আমি আজ ডেলিগেটদের কাছাকাছি থাকতে চাই। এ ব্যাপারে আপনিই আমাকে সাহায্য করতে পারেন।
কীভাবে?
আপনি আমাকে আপনার সেক্রেটারি হিসেবে ইন্ট্রোডিউস করবেন। আমি ওঁদের রিসেপশনের চার্জে থাকব।
তা কি হয়? আপনাকে আমি চিনিই না। একজন অচেনা লোকের ওপর এতটা দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া সম্ভব নয়। আপনার ক্রেডেনশিয়ালসও আমি এখনও দেখিনি।
কোটের পকেট থেকে সুধাকর তার কার্ড ও পাসপোর্ট বের করে টেবিলে রেখে বলল, দেখুন। আই অ্যাম নট অ্যান ইমপস্টার।
মনোজ দেখল। জাল বলে মনে হচ্ছে না। পাসপোর্টে বহু দেশের ইমিগ্রেশনের ছাপ আছে। সে আইডেন্টিটি কার্ড আর পাসপোর্ট ফিরিয়ে দিয়ে বলল, কাজটা বিপজ্জনক হয়ে যাচ্ছে।
আপনার পয়েন্টটা আমি বুঝতে পারছি। আমার দিক থেকে যদি ডেলিগেটদের কারও কোনও বিপদ ঘটে তা হলে আপনার এত বড় কন্ট্রাক্ট ভন্ডুল হয়ে যাবে। তাই না?