- বইয়ের নামঃ আলোয় ছায়ায়
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. একেই বলে লোনলিনেস
একেই বলে লোনলিনেস। বুঝলে! অ্যাবসোলিউট লোনলিনেস!
একা থাকতে আপনার ভাল লাগে কি?
কখনও লাগে। কখনও লাগে না। এনিওয়ে, আই হ্যাভ টু বিয়ার ইট।
কেন, আপনার তো সবাই আছে?
আছে নাকি?
স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, এমনকী মা অবধি।
সেটা আছে। তবু কেউ নেই।
আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না।
বুঝবার দরকারই বা কী? একজনের ব্যক্তিগত প্রবলেম অন্যে সবসময়ে বুঝতে পারেও না।
প্রবলেমটা কি সর্ট আউট করা যায় না?
যায়। পৃথিবীর সব প্রবলেমেরই সলিউশন আছে হয়তো।
তা হলে?
সলিউশনটা খুঁজে পেলে প্রবলেমটা মিটে যাবে।
মনে হচ্ছে, সলিউশনটা আপনি জানেন।
না, জানলে নির্বাসন নিয়েছি কেন?
এখানে কীভাবে সময় কাটে আপনার? বোরড হন না?
বোরডমও আছে, তবে সকালবেলাটা চমৎকার।
তখন বোর লাগে না বুঝি?
না। সকালে বেড়াতে যাই। ফাঁকা জায়গা। বেড়ানোর পক্ষে চমৎকার।
তারপর?
ফিরে এসে ছবি আঁকি। তখন জ্ঞান থাকে না।
রোজ?
রোজ। ছবিই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
আগে বছরে আট-দশটা আঁকতেন। এখনও তাই?
না। এখন সংখ্যাটা অনেক বেড়েছে।
বায়াররা কি এখানে আসে?
খুব কম। আমার ছবি এজেন্টের মারফতই বেশি বিক্রি হয়।
আজকাল এগজিবিশন করেন না, না?
না। ছবি বেশিরভাগই বিক্রি হয়ে যায়। এগজিবিশনটন প্রাইমারি স্টেজে হত। এখন ছবি জমে থাকে না তো।
আপনার তো এখন প্রচণ্ড ডিম্যান্ড।
হুজুগই ধরতে পারো। যারা কেনে তারা কি ছবি বোঝে?
তা বটে। যা
রা আঁকে তারাও বোঝে না।
সকালে তা হলে শুধু ছবি আঁকা?
হ্যাঁ। সকালে আলোটা ভাল পাওয়া যায়। মেজাজটাও থাকে ভাল।
দুপুরে ঘুমোন?
না, ঘুমোনোর অভ্যাসটা কম। দুপুরে বই পড়ি।
গল্পের বই?
তাও। তবে ইতিহাস আর বিজ্ঞানই বেশি।
এখানকার লোকজন দেখা করতে আসে না?
আমি তো আনসোশ্যাল। বেশি মিশি না কারও সঙ্গে। তবে দু-চারজনকে চিনি।
কথা বলতে, আড্ডা মারতে আপনার ভাল লাগে না?
না। আগে খুব আড্ডা দিতাম, যখন বয়স কম ছিল।
কফি হাউসে?
কফি হাউস ছিল, বন্ধুদের মেসবাড়ি ছিল, বসন্ত কেবিন ছিল।
সেসব দিনের কথা মনে হয় না?
হয়। তবে খুব সুখস্মৃতি নয়।
তখনকার বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই?
ইচ্ছে করেই যোগাযোগ রাখি না। কী হবে?
আড্ডায় তো অনেক ভাব বিনিময় হয়।
হয়তো হয়। তবে আড্ডায় বেশিরভাগই হয় লাইট কথাবার্তা। আমি ওটা আজকাল এনজয় করি না।
বিকেলের দিকটায় বিষণ্ণ লাগে না?
না। ভালই লাগে।
রাতে ছবি আঁকেন?
না না। কোনওদিনই আঁকতাম না। এখানে ভীষণ লোডশেডিং। কারেন্ট থাকলেও ভোল্টেজ খুব কম। রাতে কোনও কাজই করা যায় না। এখানে বাধ্যতামূলক হল আর্লি টু বেড।
এত বড় বাড়ি নিয়ে থাকেন, গা ছমছম করে না?
কেন করবে? আমার তো ভূতের ভয় নেই।
চোর-ডাকাতের ভয়?
তাও নেই। কী নেবে? ভ্যালুয়েব তত কিছু থাকে না।
ছবি তো নিতে পারে।
এখানকার চোর-ডাকাতেরা ততদূর শিক্ষিত নয় যে, ছবি চুরি করবে। ছবির বাজারদরও তারা জানে না।
তবু তারা আছে তো!
তা আছে শুনেছি। এ বাড়িতে এখনও হানা দেয়নি।
ছবি এঁকে যে আপনি প্রভূত টাকা উপার্জন করেন এটা কি তারা জানে না?
তা আমি বলতে পারব না। ছবি এঁকে টাকা রোজগার করার ব্যাপারটা শিক্ষিত সমাজের লোকে জানে। এরা ততটা ওয়াকিবহাল নয় বোধহয়। নগদ টাকা আমি অবশ্য বাড়িতে রাখি না।
সে তো বটেই। কলকাতায় যখন ছিলেন তখন বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী আপনার কাছে আঁকা শিখতে আসত।
হ্যাঁ। শেখাতে আমার ভালও লাগে।
এখানে কি কেউ শেখে?
তেমন নয়। ছবি নিয়ে কে মাথা ঘামায় বলো? এক-আধজন আসে।
আপনি শেখান?
এখানে যারা শিখতে আসে তাদের হাত খুব কাঁচা। শুধু ড্রইং শেখাই। কিন্তু সেটাও খুব ভাল নিতে পারে না।
আপনি এখানে আর কী করেন?
সন্ধের পর মদ খাই। ওটা নিয়মিত। আর বিশেষ কিছু করি বলে তো মনে পড়ছে না।
এবার আপনাকে একটা অস্বস্তিকর প্রশ্ন করব। রাগ করবেন না তো!
আরে না। রাগের কী আছে?
আপনার বয়স বোধহয় সাতচল্লিশ।
ওটা সার্টিফিকেট এজ। আসলে উনপঞ্চাশ।
যাই হোক। আপনার একটা সেক্স লাইফ থাকার কথা।
ওঃ!
রাগ করলেন?
আরে না। কথাটা হল, প্রয়োজনই আবিষ্কারের জননী।
তার মানে?
মাঝে মাঝে মেয়েছেলে চলে আসে।
চলে আসে?
আই ডোন্ট ফোর্স দেম। টাকা অফার করি।
চলে আসে কথাটার অর্থ বুঝতে পারলাম না।
আমার একজন হেলপার আছে। অড জব ম্যান। এ ব্যাপারে সে-ই সাহায্য করেছিল।
অনেক মেয়ে আসে নাকি?
না না। একজনই। স্থানীয় একজন গরিব মেয়ে। স্বামী নেয় না।
একজনই?
হ্যাঁ। কিন্তু বেশি নয়। সপ্তাহে একদিন বা বড়জোর দু’দিন।
আপনি কি আবার বিয়ে করার কথা ভাবেন?
পাগল নাকি?
এরকমই তা হলে কাটিয়ে দেবেন?
দেখা যাক। কোথা থেকে কবে কী হবে তা নিয়ে ভেবে কী করব?
কলকাতায় একটা গুজব রটেছে যে আপনি এখানে এসে একটা স্পিরিচুয়াল লাইফ কাটাচ্ছেন। ধর্মকর্ম নিয়ে মেতে আছেন।
মানুষের অনুপস্থিতিতে কত কথাই তো রটে।
আপনি বরাবর নাস্তিক ছিলেন। এখনও তাই?
নয় কেন? আমার নাস্তিক্য ভাঙার মতো কিছু তো ঘটেনি।
অনেক সুময়ে নির্জনে একা বাস করতে করতে ঈশ্বরচিন্তাও আসতে পারে তো!
না। আমার মনে হয় না, ঈশ্বরচিন্তা ওরকম অকারণে আসে। আমার ঈশ্বরকে দরকার হয়। রং, রেখা আর পৃথিবীর রূপ এসবই আমার ঈশ্বর।