- বইয়ের নামঃ ঘুণপোকা
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. সেইন্ট অ্যান্ড মিলারের চাকরিটা
সেইন্ট অ্যান্ড মিলারের চাকরিটা জুন মাসে ছেড়ে দিল শ্যাম।
চাকরি ছাড়ার কারণটা তেমন গুরুতর কিছু ছিল না। তার ড্রইংয়ে একটা ভুল থাকায় উপরওয়ালা হরি মজুমদার জনাস্তিকে বলেছিলেন, বাস্টার্ড। মজুমদার শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে গালাগাল দেয়। তা ছাড়া এতকাল শ্যাম হরি মজুমদারের অনেক হাবভাব, কথাবার্তা নকল করে আসছিল। মাঝে মাঝে বেয়ারা এবং দু-একজন শিক্ষানবিশ ড্রাফটসম্যানকে সে মজুমদারের মার্কামারা গালাগালগুলো একই ভঙ্গিতে এবং সুরে উপহার দিয়েছে। এবং এমনকী তার এ রকম বিশ্বাস এসে যাচ্ছিল যে, পুরনো এইসব গালাগালগুলো বহু ব্যবহারে শক্তিহীন হয়ে গেছে, এগুলোর আর তেমন জোর বা তেজ নেই। আরও কিছু নতুন রকমের গালাগাল আবিষ্কৃত না হলে আর চলছে না।
তবু মজুমদারের কথাটা কানে এলে দু-এক দিন একটু ভাবল শ্যাম। মাঝে মাঝে অন্যমনস্কভাবে ‘টাই’-এর ‘নট’ নিয়ে নাড়াচাড়া করল, বাথরুমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখের দিকে অর্থহীনভাবে চেয়ে রইল, আচ্ছা না মেরে ঘরে শুয়ে রইল সন্ধেবেলায়। মন-খারাপ তবু ছাড়ল না তাকে। সে নিজেকে বোঝাল যে গালাগালটা আসলে কিছুই না। মজুমদার শব্দের অর্থ ভেবে গাল দেয় না, সে শুধু ওইসব শব্দ উচ্চারণ করে রাগ প্রকাশ করে মাত্র। শ্যাম নিজেও তো কতবার কতজনকে ও রকম গাল দিয়েছে; যা নিজেই সে লোককে দিয়েছে তা ফিরে পেতে আপত্তি হবে কেন? আর, এচাকরি কিছু দিনের মধ্যেই সোনার ডিম পাড়বে। ইতিমধ্যেই সে বাজার ঘুরে ফ্রিজিডেয়ার, রেডিয়োগ্রাম এবং পুরনো ছোট্ট মোটরগাড়ির দাম জানবার চেষ্টা করেছে, বড়লোকদের নিরিবিলি পাড়ায় দুই বা তিন ঘরের ছিমছাম একটা ফ্ল্যাটের সন্ধানেও ছিল সে। তবু বড় অসহায় বোধ করল শ্যাম। চাকরি ছাড়ার কথা সে ভাবতেও পারে না, কারণ এতদিনে এ-চাকরি তাকে উচ্চাশাসম্পন্ন করে তুলেছে।
তবু আস্তে আস্তে শ্যামের ক্লান্তি বেড়ে চলল। শিস্ দিয়ে রাস্তায় হাঁটা, রবিবারে শ্যাম্পু, ছুটির দুপুরে ঘুম–এসবের ভেতর আর তেমন আনন্দ নেই। মাঝে মাঝে যে-সব বড় রেস্তরাঁ বা বার-এ সে সময় কাটাত সেসব জায়গায় যেতেও তার অনিচ্ছা দেখা দিল। অবসর সময়ে ভয়ংকর অবসাদ আর মাথাধরা নিয়ে সে ঘরেই শুয়ে থাকতে লাগল। রাতেও ভাল ঘুম হয় না। দুদিন সে মাঝরাতে উঠে স্নান করল, তারপর সিগারেটের পর সিগারেট জেলে সারাটা শেষরাত ঘরময় পায়চারি করে বেড়াল। সে খুব ভাবপ্রবণ ছিল না কোনও দিন, গভীর চিন্তাও তার অপছন্দ ছিল, হুল্লোড় ছাড়া বাঁচা যায় না এমন বিশ্বাসই সে এতকাল পুষে এসেছে। কিন্তু ক্রমে বুঝতে পারল একটি গালাগাল থেকে একটি ভূত বেরিয়ে এসে তার মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর-একটা বদ-অভ্যাস দাঁড়িয়ে গেল তার—কেবলই সে আয়নায় মুখ দেখে। দাড়ি কামানোর ছোট্ট হাত-আয়নাটা সে প্রায় সারাক্ষণ কাছে রাখে। বার বার মুখ দেখে। একদিন সে সবিস্ময়ে আয়নায় লক্ষ করল যে, তার ঠোঁট নড়ছে। সে উৎকর্ণ হয়ে শুনল যে, সে বে-খেয়ালে আপনমনে উচ্চারণ করে চলেছে, বাস্টার্ড। বাস্টার্ড। খুব ভয় পেয়ে গেল শ্যাম, পাগল হয়ে যাচ্ছি না তো!
অবশেষে জুন মাসের এক ভয়ংকর গ্রীষ্মের মাঝরাতে উঠে টেবিলল্যাম্প জ্বেলে সে তার ইস্তফাপত্রটি লিখে ফেলল। আর-একটা চিঠি লিখল মাকে… আমার চাকরি গিয়াছে। আমার উপর আর খুব ভরসা করিও না। অন্তত আরও দু-তিন মাস তোমাদের কষ্ট করিয়া চালাইতে হইবে… ইত্যাদি। চিঠি লিখবার পর সেই রাতে তার গভীর ঘুম হল।
শৌখিন জিনিসপত্রের মধ্যে তার ঘরে ছিল ভাড়া করা একটা ওয়ার্ডরোব আর একটা বুক-কেস। রূপশ্রী ফার্নিচার্স থেকে নোক এসে একদিন ঠেলাগাড়িতে তুলে সেগুলো নিয়ে গেল। মেঝের ওপর তূপাকৃতি বই, ওয়ার্ডরোব আর বুক-কেসের দুটো চৌকো দাগ থেকে চোখ তুলে ঘরটাকে বেশ বড় বলে মনে হল তার। অনেক সুস্থ বোধ করল সে। ভারমুক্ত। হিসেব করে দেখল ফার্ম থেকে সে প্রভিডেন্ট ফান্ডের যে টাকা পাবে তাতে ঘরটা আরও কিছু দিন রাখা যাবে। দক্ষিণ-খোলা সুন্দর ঘরটি তার, সঙ্গে মান-ঘর।
সুতির জামাকাপড় পরা অনেক দিন হয় ছেড়ে দিয়েছিল শ্যাম। তার বেশির ভাগই টেরিলিন, ট্রপিকাল বা সিল্কের শার্ট-প্যান্ট। বিদেশি টাইও ছিল কয়েকটা। ট্রাঙ্ক আর সুটকেস খুলে সেগুলোর দিকে কৌতুকের চোখে চেয়ে দেখল সে। এখন আর এসব পরার মানে হয় না। খুঁজেপেতে সে ট্রাঙ্কের তলা থেকে পুরনো কয়েকটা সুতির শার্টপ্যান্ট বের করল। প্যান্টের ঘের আঠারো ইঞ্চি, শার্টের কলার অনাধুনিক। সেগুলো পরে নিজেকে বেঢপ মনে হচ্ছিল তার। হাসি চেপে সে সেই পোশাকে চাকরি খুঁজতে বেরোল।
চাকরি? হ্যাঁ, হতে পারে। তার মতো অভিজ্ঞ, অথচ তরুণ লোকের চাকরি আটকাবে না। তবে, একটু দেরি হবে। আর হ্যাঁ, সে হরি মজুমদারের ফার্ম ছাড়ল কেন? কোনও গোলমাল হয়েছিল? কী ধরনের গোলমাল! অত বড় ইঞ্জিনিয়ার, শেল ডিজাইনে যার জুড়ি নেই! তা ছাড়া দেশি ফার্ম দেশের অহংকার! অমন লোকটাকে ছাড়ল কেন সে?