- বইয়ের নামঃ অঘোরগঞ্জের ঘোরালো ব্যাপার
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ অদ্ভুতুড়ে সিরিজ
১. শঙ্কাহরণ আর বিপদভঞ্জন বিদ্যাধরী
অঘোরগঞ্জের ঘোরালো ব্যাপার – অদ্ভুতুড়ে সিরিজ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
শঙ্কাহরণ আর বিপদভঞ্জন বিদ্যাধরী নদীর ধারে বটতলায় বসে ভুট্টা খাচ্ছিল। সকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি। দু’জনেরই কাজ নেই। শঙ্কাহরণের খানিকটা জমি ছিল, সেটা মহাজন নিয়ে নিয়েছে। বিপদভঞ্জন কুমোরের কাজ করত, সেই ব্যবসা আর চলছে না। একটু আগে গদাধরবাবুর বাড়িতে কায়দা করে ঢুকে পড়েছিল দু’জনে। আজ গদাধরবাবুর মেয়ের বিয়ে। রাতে বড় ভোজ। কিন্তু মেলা আত্মীয়কুটুম্ব আর কাজের লোকের জন্য দুপুরেও ঢালাও ব্যবস্থা। তারা ভেবেছিল ভিড়ের মধ্যে মিলেমিশে ভোজে বসে যাবে। তা বসেও ছিল। কিন্তু হঠাৎ নদেরাদ আর কানাইবাশি তাদের দেখে চিলচেঁচানি চেঁচাতে লাগল, “অ্যাই, এরা তো কাজের লোক নয়! এরা তত উটকো লোক, ঢুকে পড়েছে খাওয়ার লোভে। বেরোও, বেরোও–”
দু’একজন দয়ালু লোক “থাক না, থাক না’ বলছিল বটে, কিন্তু বাদবাকি সবাই খাপ্পা হয়ে এমন হুড়ো লাগাল যে, পালানোর পথ পায়নি তারা।
ভুট্টা শেষ হয়ে গেছে। দু’জন বসে বসে কথা কইছে। তাদের কথারও বিশেষ মাথামুণ্ডু নেই।
শঙ্কাহরণ দুঃখ করছিল, “বুঝলি বিপদ, লেখাপড়া শিখলে বোধ হয় কিছু সুবিধে হত!”
বিপদভঞ্জন বলল, “কথাটা আমিও ভাবি। তবে কিনা লেখাপড়া হল ভারী জিনিস। মাথায় সেঁদোলে মাথাটার বড্ড ওজন বেড়ে যায়।
ক্লাস টু’তে ওঠার পর রোজ ইশকুল থেকে ফেরার সময় আমার মাথা টাল খেত।”
“দুর বোকা! তা হলে গোপীপণ্ডিত, নরহরিমাস্টার, সুদাম তর্কালঙ্কার চলেফিরে বেড়াচ্ছে কী করে? তুই তো মোটে টু, আমি তো থ্রি টপকে প্রায় ফোরে উঠে গিয়েছিলুম আরকী। শ্যামাপদস্যার কাছে ডেকে আদর করে বললেন, ‘সবাই ফোরে উঠে গেলে থ্রি যে একেবারে ফাঁকা হয়ে যাবে বাপ! বাছা-বাছা কয়েকজনকে রেখে দিচ্ছি আরকী। তুইও আর-একটা বছর ঘষটান দে। ক্লাস থ্রি তোকে ছাড়তে চাইছে না!’ শুনে বুঝলুম, আমি ফেল মেরেছি। অথচ ফেল মারার কথা নয়। শ্যামাপদস্যারের জন্য কী-না করেছি বল! তাঁর হারানো গোরু খুঁজে এনে দিয়েছি। তার মায়ের জন্য গঙ্গামাটি জোগাড় করে দিয়েছি। তার ফুটো ঘটি গঞ্জ থেকে ঝালাই করে এনেছি।”
বিপদভঞ্জন আড়মোড়া ভেঙে বলল, “জেগে থাকলেই ঝামেলা! ওর চেয়ে পড়ে-পড়ে ঘুমোলে সময়টা বেশ কেটে যায়। খিদের ভাবটাও থাকে না।”
শঙ্কাহরণ হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলল, “ওটা কী ভেসে যাচ্ছে বল তো! মড়া নাকি?”
বিপদভঞ্জন উদাস গলায় বলল, “তা হবে। গরিবেরা তো পয়সার অভাবে দাহ করতে পারে না, অমনই ভাসিয়ে দেয়।”
“তেমন মনে হচ্ছে না। গায়ে জামাকাপড় আছে। চল, তুলি।”
“তুলে কী হবে?”
“বেঁচেও তো থাকতে পারে। জলে পড়ে গেছে হয়তো!”
“দুর দুর, ভাল করতে গিয়ে কোন ফ্যাসাদে পড়তে হয় কে জানে! আমাদের কপাল তো ভাল নয়।”
“আহা, ধর্ম বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। গামছাখানা কোমরে বেঁধে নে। দুপুরে স্নানটাও হয়ে যাবে এই তালে।”
বিদ্যাধরী এমনিতে বড় নদী নয়, তবে বর্ষার জল পেয়ে এখন তার বিশাল চেহারা। স্রোতও মন্দ নয়। লোকটা মাঝগাঙ বরাবর বেশ তোড়ে ভেসে যাচ্ছিল। তবে কিনা শঙ্কাহরণ আর বিপদভঞ্জন দু’জনেই পাকা সাঁতারু। তারা জলে নেমে ভাসন্ত মানুষটার পিছু নিল।
মাইলটাক গেলে বিদ্যাধরীর একটা ঘূর্ণী স্রোত আছে। তাতে পড়লে রক্ষে নেই। শঙ্কাহরণ আর বিপদভঞ্জন প্রাণপণে জল কেটে ঘূর্ণীর আগেই লোকটাকে ধরে ফেলল। তারপর টেনে আনল ডাঙায়। যে জায়গায় তারা লোকটাকে জল থেকে তুলল সে ভারী নির্জন জায়গা। পাশেই শ্মশানঘাট।
লোকটাকে ঘাসের উপর উপুড় করে শুইয়ে দু’জনে খানিক দম নিল।
বিপদভঞ্জন বলল, “এত হাঁফ ধরছে কেন বল তো? এ নদী তো আমি দিনে চোদ্দোবার এপার-ওপার করতে পারি।”
“পেটে দানাপানি না থাকলে দম আসবে কোথা থেকে?”
খানিকক্ষণ জিরিয়ে হাঁফটা একটু কমলে বিপদভঞ্জন বলল, “বেঁচে আছে কিনা দেখেছিস?”
“মনে হচ্ছে না। খাটুনি বোধ হয় বৃথাই গেল!”
“একটু ডলাইমলাই করে দেখবি নাকি?”
উপুড় হয়ে পড়ে থাকা লোকটার বয়স বেশি না। তিরিশের নীচেই। পরনে বেশ ভাল একখানা প্যান্ট, গায়ে সিল্কের হাফহাতা পাঞ্জাবি। গায়ের রংটা ফরসা, মুখে দাড়ি-গোঁফ আছে। বেশ লম্বা আর ছিপছিপে।
বিপদভঞ্জন বলল, “দেখে তো ভ ভদ্রলোক বলেই মনে হচ্ছে রে!”
“হুঁ।”
দুজনে মিলে লোকটার পিঠে কিছুক্ষণ ডলাইমলাই করল। চাপ খেয়ে হঠাৎ লোকটার মুখ দিয়ে ভকভক করে জল বেরোতে লাগল।
বিপদভঞ্জন বলল, “কী মনে হচ্ছে রে?”
“প্রাণের লক্ষণ দেখি না। তবে আর-একটু চেষ্টা করে দেখলে হয়। কপাল ভাল থাকলে বেঁচে যেতেও পারে!”
“হাতে দামি ঘড়ি আছে দেখেছিস?”
“দেখেছি।”
“পাঞ্জাবিতে সোনার বোতাম। প্যান্টের বাঁ পকেটে মানিব্যাগও আছে মনে হচ্ছে। যদি না বাঁচে তবে এসব কাকে ফেরত দেব বল তো!”
“তা জানি না। তবে বোধ হয় থানায় জানানোর নিয়ম আছে।”
“ও বাবা, তা হলে আমাদেরই ধরে ফাটকে পুরবে।”
“তাও বটে।”
“তাই তো বলছিলাম, ভেসে যাচ্ছিল, তাই যেত। খামোখা উটকো ঝামেলা ঘাড়ে নিলি!”