- বইয়ের নামঃ কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- প্রকাশনাঃ জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অর্ফির বাঁশির মতো
কত কিছু খসে যায়, সরে যায়, ঝরে যায় ক্রমে
আমার জীবন থেকে। শৈশবের কাগজের নৌকো,
বাবুই পাখির বাসা, তালপাতার ভেঁপু, বৈশাখের
উন্মত্ত হাওয়ায় আমগাছের তলায় ছুটোছুটি
বালক-বালিকাসহ, খুব ভোরবেলা পাতে-দেয়া
নানির হাতের পিঠা ঝরে গেছে সুদূর আড়ালে।
স্কুলে সহাপাঠী ছিল যারা, তারা কে কোথায়
সরে গেছে বহুদূরে; কারো নাম, কারো মুখ
ভুলে গেছি আর বাবুবাজারের মোহন কাঁচের
দোকানের তীর বিদ্ধ দুলদুল পঙ্গপাল-ছাওয়া
সোনালি শস্যের মতো ঝরে গেছে স্মৃতির প্রান্তরে।
জনকের উঠোনে ঘুরতো কান্তিমান দুটো হাঁস,
সুপ্ত ওরা; মাতামহ ঝাপ্সা পুরাণ, এমনকি
পিতৃস্মৃতি মাঝে-মধ্যে মেঘের আড়ালে বড় বেশি
ছায়াচ্ছন্ন হয় আর আজ কাছে আছে যারা, হায়,
তারাও কেমন দূরত্বের কুয়াশায় মুখ ঢাকে।
নিদ্রায় ভ্রমণকারী ওরা, নিশীথে হারিয়ে যায়।
কত কিছু খসে যায়, সরে যায়, ঝরে যায় ক্রমে
আমার জীবন থেকে। একদা বসন্তোৎসব দেখে
যার চোখে লক্ষ পদ্ম ফুটেছিলো হৃদয়ে আমার,
যাকে ছুঁয়ে জেনে গেছি অমরত্ব বলে কাকে, সে-ও
আমার সকল আকাঙ্ক্ষার বহ্ন্যৎসব করে যায়
দীর্ঘ পরবাসে। শুধু তুমি হে আমার বর্ণবোধ,
মাতৃভাষা ক্রমশ আমার আরো কাছে এসে যাও,
অস্তিত্বের গ্রন্থিমূলে অর্ফির বাঁশির মতো বাজে।
আবার যাবে কি চলে?
আবার যাবে কি চলে অভিমানে দীর্ঘ পরবাসে
আমাকে খরায় ফেলে? পথক্লেশ, না কি মতিভ্রম,
কী আমার দোষ
বুঝতে পারিনি ঠিক, তবু শেষমেষ
রেখেছি তোমারই প্রতি অঞ্জলি আমার। শূন্য রইলে করতল,
আমার সকল দিক হবে চির হাহাকারময়,
কংকালে-কংকালে যাবে ছেয়ে শূন্য ভূমি।
তুমিহীনতায় অবেলায়
আমার একান্ত অন্তর্গত অনল ফুরিয়ে গেলে
নিঃসঙ্গ থাকবো পড়ে সীমাহীন শীতে
ভীষণ আহত।
কখনো বেগানা কোনো কুকুর শুঁকবে এসে ছেঁড়া
জামার রক্তের দাগ, শরীরের বর্ধমান ক্ষত।
অথচ এ-ও তো জানি, বসন্তমায়ায়
শহরের নিঝুম কবরখানাতেও
বেলা শেষে কোকিল ব্যাকুল ডেকে যায়।
দূরে আছি, তোমার নিকট থেকে বহুদূরে আছি-
যেমন আকাশ থেকে দুর্বল ডানার কোনো পাখি,
শস্যময় ক্ষেত থেকে উপদ্রুত চাষী,
অন্ধের নিকট থেকে জ্যোতি
কবির নিকট থেকে অভীষ্ট প্রতিমা শব্দেশ্বরী।
দূরত্বের অস্তহীন মরুর সিমুম ঝড়ে দিশাহারা আমি
রোজই ভাবি, দেখা হবে আমাদের কখনও আবার
বনানীর স্নিগ্ধতায়, দীর্ঘ গাঢ় লাল বারান্দায়।
যে-পথ সন্ধ্যার স্পর্শ পেয়ে কেমন মায়াবী হয়,
তার দিকে চোখ পড়ে হঠাৎ যখন,
যখন কোথাও দেখি অপরাহ্নে নতুন ব্লেডের মতো ঝিল,
মনে হয় দেখা হবে আমাদের, দেখা হবে তোমার রূপের স্তব্ধতায়।
আবার যাবে কি চলে? এখনই যেও না,
ফিরিয়ে নিও না মুখ; তুমি
না তাকালে আমি হৃতদীপ্তি, হীনবল
ঈগলের মতো পঙ্গু ডানা নিয়ে হাওয়ার ধিক্কারে
ক্ষয়ে-ক্ষয়ে
নিষ্ফল ক্ষোভের ভারে শ্বাসকষ্টে ভূগি সর্বক্ষণ-
পাহাড়ের চূড়া থেকে নিচে, বহু নিচে
হয়তো কচুরিপানাময় এঁদো ডোবায় অথবা খানাখন্দে
খুব অসহায় মুখ থুবড়ে পড়বো ভেবে ভয়ে নীল হই।
তুমি না বাড়ালে হাত পণ্ড হবে যজ্ঞ সুন্দরের,
ঋত্বিক যাবেন ভুলে মন্ত্র, হোমাগ্নি না জ্বেলে দ্রুত
পুড়িয়ে দেবেন সুশ্রী মণ্ডপ বেবাক;
সুসৌম্য আলেম কোরানের পাতা না উল্টিয়ে ভ্রমে
ঐন্দ্রজালিকের কালো নিষিদ্ধ কেতাবে
দৃষ্টি বুলোবেন।
এখন থেকো না দূরে, এসো চলে এসো-
হে মেয়ে তোমার আশা করার মধ্যাহ্নে স্নিগ্ধ ছায়া,
ফসলের আভা,
দীর্ঘ পরবাসে যোগাযোগহীন পত্রপ্রার্থীদের
সম্মেলনে অলৌকিক ডাক পিয়নের চিঠি বিলি,
অন্ধের ইশ্কুলে ব্রেইলির
ব্যাপক দেয়ালি, মৃত শহরের ধু-ধু স্তব্ধতায়
প্রবল আশ্বাসময় দৈব উচ্চারণ।
আশি দশকের পদাবলি
একটি কেমন পাখি ছায়াকে স্বপ্নের মতো বাহার করে
ঘরের ভেতরে আসে। ডানা থেকে টেবিলে লাফিয়ে
পড়লো কবিতা লাল বলের মতন।
হকারের হাত থেকে খসে পড়ে ভোরবেলাকার
খবর-কাগজ, ঝকঝকে
লাইনো টাইপগুলি মনিপুরী নাচের ধরনে
ঘূর্ণমান কিছুক্ষণ, অনন্তর কবিতার মুখ।
শ্রাবণ ধারায় ভেজা ভাঙা জানালায়
রোদের ঝলক, জ্যোৎস্না রাতে
সরুগলি বোবা তরুণীর মতো স্তব্ধ; কলোনির
ফ্ল্যাট থেকে ঝুলে থাকে কবিতার হাত,
যেন ক্রূশকাঠে জেসাসের বিশীর্ণ সাধক হাত।
আমার দেরাজ খুলে দেখি
নিজস্ব কাগজপত্র, চিঠি, ক্যাশমেমো, লন্ড্রির রশিদ আর
স্মৃতির মতন গোলাপের পাপড়ি, কিছু ফটোগ্রাফ। অকস্মাৎ
একরাশ গন্ধরাজ কাঠ
দীর্ণ করে প্রস্ফুটিত দেরাজের ভেতরে। খরগোশ
কোমল তাকায় ক্যালেন্ডারের রঙিন
তরুণীর দিকে
আমার টেবিলে বসে। কবেকার লাল ঝরাপাতা
চমৎকার উড়ে আসে খাতার পাতায়,
মিশে যায় যুবতীর ডাগর স্তনের
কিশমিশ, বেলা-পড়ে আসা সান্দ্র প্রহরে আহত
টিয়ের পালক আর আস্তিনের ঘ্রাণসহ নেভীব্লু কালিতে।
সোফার অতীতে হাই তোলে, বর্তমান জ্বলে
উৎসবের মতো, যেন বিবাহ বাসরে
দু’জন রমণে লিপ্ত, অজস্র নক্ষত্র স্পন্দমান
যুগল সত্তাকে ঘিরে। যখন রাত্রির কিশোরীর
মতো বয়সিনী,
তখনই রাত্রিকে খুব ঘনিষ্ঠ পাওয়ার জন্যে ওরা
তীব্র গুঞ্জরণময় শহরের হট্ররোল থেকে কিছু দূরে
দাঁড়ায় শহরে মাঠে বহুদিন পর। গোধূলিতে
কেবলি গুমরে ওঠে, টেলিফোনে বিদায়ের গহন বেহাগ-
আবার এয়ারপোর্ট, প্লেনের গর্জন, ফিরে-আসা, চলে-যাওয়া
সময়কে বুনে চলে স্বপ্নের রীতিতে।
অশেষ অভ্রের স্তরে স্তরে মাইল স্টোনের মতো
কী এক রহস্যময় সংকেত প্রোথিত, বিরানায় যোজন-যোজনব্যাপী
ফণিমনসায়
কবিতার ত্রিকালজ্ঞ চোখ জেগে থাকে।
একথা সবাই জানে, মানে না সে টাইম টেবল;
যখন যেখানে খুশি হরিণের মতো লাফ দেয়,
চিতার চোখের মতো ধক জ্বলে,
উচ্ছুসিত হয়ে ওঠে ফোয়ারার মতো। মধ্যরাতে
আশি দশকের পদ্যাবলী কী ব্যাকুল
ডেকে ওঠে ফুটপাতে, ধাবমান শেষ বাসে আর
অন্ধকার ফ্ল্যাটের ভেতরে বারংবার।