- বইয়ের নামঃ মাকু
- লেখকের নামঃ লীলা মজুমদার
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
০১-০৫. নতুন খেলনাগুলো
নতুন খেলনাগুলোকে আলমারির মাথায় তুলে দিয়ে আম্মা বলল, তোমাদের বাপি বললে আর আমি কী করতে পারি বলো, কালিয়ার বন থেকে যে আস্ত কেউ ফেরে না, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই। কেন, আমার নিজের মামাতো পিসেমশাই গোরু খুঁজতে সেখানে গিয়ে, গোরু তো পেলই না, বরং সাত দিন সারা গা চুলকে সারা, সর্বাঙ্গে এই দাগড়া দাগড়া চাকায় ভরে গেল!
সোনা বলল, ধেৎ! বাপি বলেছে ও আমবাত। তা তোমাদের বাপি আমবাত জামবাত যা খুশি বলতে পারে, এককালে তো পেয়ারাকে পেয়ালা বলত, তবে পাড়াসুদ্ধ সকলে বলল ওকে চুলবুলিতে ধরেছে। শেষটা সাড়ে তিন টাকা খরচ করে, কালিয়া বনের দেউকে পুজো দিয়ে ঠান্ডা করে, তবে-না দাগ মিলিয়ে গেল। মোড়ল তো বলেছিল পিসেমশাইয়ের বাঁচার কথাই ছিল না নেহাত কানের কাছ দিয়ে ঘেঁষে কোনোমতে বেরিয়ে গেছে। এসব কথা যেন আবার মামণির কানে তুলো না।
পাশের বাড়ির তোতাদের আয়াও সেদিন সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। সে বলল, নাহয় মার কানে না তুলল, তাই বলে তো আর কথাটা না-ই হয়ে যায় না। কে না জানে আমার ছোটো ভাই পানুয়া ওই বনেই নিখোঁজ হয়ে গেছে আজ পনেরো বছর হল। মার কানে না তুললেও তো আর পানুয়া ফিরে আসবে না!
এই বলে আয়া আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখ মুছে মুছে দেখতে দেখতে লাল করে ফেলল। তোতা বললে, আয়াদিদি, তোমার যেমন কথা! বাড়ির মাস্টারমশাই বলেছেন, তোমাদের পানুয়া মোটেই বনে নিখোঁজ হয়নি। মোড়লের সঙ্গে মারপিট করে, পেয়াদার ভয়ে ফেরারি হয়ে গেছে।
রাগে আয়ার তুলতুলে গাল দুটো শক্ত হয়ে উঠল, ছিঃ তোতা, মাস্টারমশাইয়ের কাছে আমাদের ঘরের কথা বলতে গেলে কী বলে! মেয়েদের একটু লজ্জা থাকা ভালো। আম্মা ওর পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, ওরা ওইরকম দিদি, বড্ড অলবচ্ছে, ওদের কি অত বুদ্ধি আছে!
আম্মা বাপির ছোটোবেলাকার ধাইমা, বাপি ওকে আইমা বলে ডাকত। সোনা যখন ছোটো ছিল, আইমা বলতে পারত না, বলত আম্মা; লজেঞ্জুসকে বলত দাদুচ, লেবুকে বলত দেবু। টিয়া এক বছরের ছোটো, দিদির দেখাদেখি সেও বলে আম্মা।
পুতুল তুলে রেখে আম্মা পা ছড়িয়ে মাটিতে বসে সুপুরি কুচোনোর আঁতি দিয়ে নারকোল কুচোতে লাগল। তোতাকে নিয়ে আয়া বাড়ি চলে গেলে পর সোনা একটা তিনঠেঙা টুল আনতেই, আম্মা সেটা হাত বাড়িয়ে কেড়ে নিল, চালাকি চলবে না, সোনা! ওসব খেলনা পিসির ছেলের জন্যে। জন্মদিনে এই এত খেলনা পেলে, ঠেলাগাড়ি, বেবিপুতুল, পেয়ালা-পিরিচ, সত্যিকার চামচ-কাঁটা, তা সেসব সাত দিন না পেরুতে ভেঙে নাশ করে দিলে! খবরদার যদি পিসির ছেলের খেলনাতে হাত দিয়েছ! যাও-না, বাগানে গিয়ে খেলা করো; নোনোর শেকল খোলা, দেখো তো সে পালিয়েছে কি না; আঃ, যাও-না, এখান থেকে, কাজের সময় গোল কোরো না।
টিয়া এক মুঠো নারকেল কুচো তুলে নিতেই আম্মা আরও রেগে গেল, হাঁ-হাঁ-হাঁ, নিয়ো না বলছি, এক কুচি নিয়েছ তো আমি তোমাদের মামণিকে বলে কেমন বকুনিটা খাওয়াই দেখো। এসব তোমাদের জন্যে নয়।
সোনা বলল, তাহলে কাদের জন্যে? বাপি মামণি মিষ্টি খায় না।
–আরও খাবার লোক আসছে গো, পিসি মিষ্টি খায়, পিসে খায়, ওদের খোকাও খায়। এখন সর দিকি, নারকোলচিড়ে হবে, ইচামুড়ো হবে, ক্ষীর ঘন করব।
সোনা বলল, বেশ, ওদের খাওয়াও, আমরা চাই না। টিয়া বলল, আমরা পুঁটলি নিয়ে কালিয়ার বনে চলে যাচ্ছি। আমার পুঁটলিতে মামণির পুরোনো পাউডারটা নিয়েছি।
সোনা বলল, চুপ, বোকা। আম্মার কালো সুতোবাঁধা স্টিল ফ্রেমের চশমা নাকের উপর নেমে এল, সেটাকে তুলে সে বলল, তাই যাও, কাজের সময় জ্বালিয়ো না, যাও-না দু-টিতে, মজাটা বোঝো গিয়ে।
সোনা-টিয়া হাসতে লাগল। কী ভয় দেখাচ্ছ? বাপি বলেছে বাঘ-ফাঘ নেই জঙ্গলে, সাহেব শিকারিরা কবে মেরে শেষ করে দিয়েছে। টিয়া বলল, খালি এই বড়ো বড়ো লাল-নীল বেগনি প্রজাপতিরা আর কাঠঠোকরা পাখি আছে, তারা ঝুঁটিমাথা নীচের দিকে করে গাছের গায়ে গর্ত খোঁড়ে।
দু-জনে পেছনের বারান্দার জালের দরজা খুলে বাইরে পা দিতেই আম্মা চাঁচাতে লাগল, ভালো হবেনা বলছি সোনা টিয়া, এমন দুষ্টু মেয়েও তো জন্মে দেখিনি, নিজের পিসির খোকা আসছে বলে হিংসায় জ্বলে পুড়ে খাক হল। যেয়ো না বলছি।
আম্মার চশমাটা এবার সত্যি নাক থেকে খসে মাটিতে পড়ে গেল। সেটাকে না তুলেই আম্মা চঁচাতে লাগল, বেশি বাড়াবাড়ি কোরো না, সোনা টিয়া, জঙ্গলে বাঘ না থাকতে পারে বাঘ আর এমন কী, তাকে গুলি করে মেরে ফেলা যায়, কিন্তু কালিয়ার বনের ভয়ংকরের গা থেকে গুলি ঠিকরে পড়ে, এ অনেকের নিজের চোখে দেখা।
জালের দরজার বাইরে থেকে সোনা টিয়া হি-হি করে হাসতে লাগল।
যাও গে, পিসির খোকাকে ওসব গাঁজাখুরি গল্প বলো, আমরা স্কুলে ভরতি হয়েছি, আমরা ভয় পাই না! এই বলে সোনা-টিয়া খিড়কি-দোরের খিল খুলে ফেলল। কী করবে আম্মা? বাড়িতে আরেকটা লোকও নেই, খালি ঠামু ঘর বন্ধ করে ঘুমুচ্ছে, ডাকলে বেদম চটে যাবে, বাপি মামণি পিকনিকে গেছে, ঠাকুর গেছে দোকানে, চাকরদের কারো টিকির দেখা নেই। আম্মার পায়ে গুপো, উঠতে বসতে কষ্ট হয়, তাড়াতাড়ি চলতে গেলে হাঁটুতে খিল ধরে, তাই ভাঙা গলায় সমানে সে চাঁচাতে লাগল, ও সোনা-টিয়া, যেয়ো না বলছি, কালিয়ার বনে আমার ঠাকুরদা হরিণ ধরতে ফঁদ পেতেছিল, তাতে কী পড়েছিল মনে নেই?