- বইয়ের নামঃ বকধার্মিক
- লেখকের নামঃ লীলা মজুমদার
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
০১-০৫. ছোটোবেলায় পাহাড়ের দেশে থাকতুম
০১.
ছোটোবেলায় পাহাড়ের দেশে থাকতুম। সেখানে বাড়ির পেছনে ঢালুর নীচে নুড়ি পাথরের ওপর দিয়ে ছলছল করে পাহাড়ি নদী বয়ে যেত। সরল গাছের বনের মধ্যে দিয়ে হু হু করে হাওয়া বইত। রাতে নদীর ধারে ধারে ঝোপেঝোপে হাজার হাজার জোনাকি জ্বলত।
ছোটো শহর; চা-বাগানের সাহেবরা অনেকে সেখানে বাড়ি নিয়ে মাঝে মাঝে থেকে যেত। ইস্কুল, ক্লাব, হাসপাতাল, আপিস, আদালত, ব্যাঙ্ক, জেলখানা সবই ছিল। তবু লোকে বলত এখানে কখনো কিছু হয় না। বাড়ির দরজা খুলে রেখেই বেড়াতে বেরুত, সই না নিয়ে টাকা ধার দিত, নগদ পয়সা দিয়ে কেউ কিছু কিনত না, মাস কাবারে মাইনে পেলে যে যার ধার শোধ করে দিত।
সবাই সবাইকে চিনত সেখানে; কাউকে বলত খুড়ো, কাউকে বলত দাদা। ম্যাজিস্ট্রেটকে সবাই ভয় করত; দারোগাবাবু, পোস্টমাস্টার ইস্কুলের হেডমাস্টারকে খাতির দেখাত; হাসপাতালের ডাক্তারবাবুকে ভালোবাসত।
সবাই সবাইকে চিনত সেখানে; মাঝে মাঝে ঝগড়াঝাটিও হত, তবু কারো বাড়িতে কোনো কারণে খাওয়া-দাওয়া হলে, পাড়াসুদ্ধ সকলের ডাক পড়ত।
তখন দিনকাল ছিল ভালো, ঘিয়ের সের টাকা-টাকা, দুধ ছিল টাকায় সাত সের, মিলের কাপড় তিন টাকা জোড়া। তবু জেলখানা খালি থাকত না। কোথায় কে জুয়ো খেলেছে, নেশা করেছে, গাঁট কেটেছে, তাদের ধরে এনে, হাজতে জিম্মা করে দেওয়া হত। তাদেরই বলা হত দাগি চোর; ছাড়া পেয়ে পথ দিয়ে হেঁটে গেলে, লোকে তাদের আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিত। মাথা নীচু করে হাঁটত তারা।
সেই সময়কার কথা।
হঠাৎ একদিন সব পালটে গেল। তার আগের দিন সন্ধ্যে বেলা পর্যন্ত কোনো কিছু জানা নেই, যেমনকে তেমন সব চলেছে। সকাল বেলাও নাপিতরা রোজকার মতো খেউরি করতে বেরিয়ে, এ-বাড়ির খবর ও-বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে।
আপিস যাবে বলে আমাদের পাড়ার জগদীশদা স্নান সেরে চুল আঁচড়াচ্ছে, এমনি সময় ওর পিসিমা আলমারি খুলে একটা সোনার কৌটো বের করে বললেন, এটাকে কখনো দেখেছিস? এর ইতিহাস শুনেছিস?
জগদীশদা তো থ! গোল গোল চোখ করে বলল, ইস্, পিসিমা, অ্যাদ্দিন কোথায় রেখেছিলে এ-জিনিস? পেলে কোথায়?
পিসিমা কাষ্ঠ হেসে বললেন, এত ভালো জিনিস এ পাপের সংসারে কি আর সদুপায়ে পাওয়া যায় ভেবেছিস? আমার বাবা এটাকে জুয়ো খেলায় জিতেছিলেন।
জগদীশদা হাত বাড়িয়ে বললে, দেখি, দেখি কীরকম জিনিস। আরে এ যে নস্যির কৌটো দেখছি। বাবা! সোনা দিয়ে গড়া, তার ওপর লাল সবুজ পাথর বসানো! কিন্তু ঢাকনির মাঝখানে ছাদা কেন, পিসিমা? নস্যি পড়ে যাবে যে!
পিসিমা বললেন, আরে ওইখানে যে স্ক্রুপ দিয়ে একটা হিরের প্রজাপতি বসানো ছিল।
জগদীশটা বললে, কই, কই সেটা?
পিসিমা একটু চুপ করে থেকে বললেন, কী জানি।
জগদীশদা তখন খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলল, তোমার কাছে এত দামের জিনিস আছে, তবু, তুমি কেন আমি মাইনে পেলেই খালি খালি টাকা দাও টাকা দাও করো?
পিসিমা তো অবাক!
ওমা, সেকি আমার নিজের জন্যে বলি রে? সব তো প্রায় তুই-ই খাস। আর এটাকেও কি আমার নিজের জন্যে রেখেছি নাকি? তোর বউ এলে, এতে সিঁদুর ভরে তাকেই দেব মনে করেছি।
জগদীশদা ফুটো দেখিয়ে বললে, কিন্তু ওইখান দিয়ে সিঁদুর পড়ে যে বউয়ের শাড়িতে মেখে একাকার হবে। প্রজাপতিটা কই?
পিসিমা তার কোনো উত্তর না দিয়ে, দেরাজ থেকে ছোট্ট এক টুকরো লাল শালু বের করে, তাই দিয়ে কৌটোটাকে বেশ করে মুড়ে, জগদীশদার হাতে দিলেন।
দ্যাখ, এটাকে আর বাড়িতে রাখতে সাহস হচ্ছে না, তুই বরং আপিসে টিফিনের ছুটি হলে, ওটা ব্যাঙ্কেই জমা দিয়ে দে। খুব সাবধানে রাখিস কিন্তু, এর দাম শুধু টাকাপয়সা দিয়ে নয়। কে জানে এর জন্যে হয়তো আমার বাবা বেচারিকে নরক ভোগ করতে হচ্ছে। সে যাক গে; কিন্তু খবরদার, ব্যাঙ্কের লোহার দেরাজে তালাচাবি বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত, এক মিনিটের জন্যেও একে হাতছাড়া করবি নে।
জগদীশদা পুঁটলিটাকে প্যান্টের পকেটে পুরতে পুরতে বলল, আচ্ছা, আচ্ছা, আর বলতে হবে না। আমার বউকেই দেবে তো ঠিক? শেষটা?
পিসিমা চটে গেলেন।
তোর বউকে দেব না তো আবার কাকে দেব? তুই ছাড়া আর তিন কুলে কে আছে রে আমার?
জগদীশদা কাগজপত্র গুছোতে গুছোতে হেসে বলল, থাকলে তো আমি বাঁচতুম!
পিসিমার মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। না রে জগদীশ, হাসিঠাট্টার কথা নয়। শুনেছি যার কাছ থেকে বাবা ওটাকে জিতেছিলেন, সে নাকি প্রতিজ্ঞা করেছিল, যেমন করেই হোক, নাতনির বিয়েতে ওইটেকেই যৌতুক দেবে। তুই বলিস কী রে জগদীশ, অ্যাদ্দিনে তার বিয়ের বয়েস হয়ে গেছে। ওটাকে আর বাড়িতে রাখা নয়।
তারপর দুগগা দুগগা বলে জগদীশদাকে রওনা করে দিতে দিতে আরও বললেন, দ্যাখ দিকিনি অন্যায়টা! কী এমন দোষ করেছিলেন বাবা বেচারি? যারা জুয়ো খেলবে তারাও যদি একটু-আধটু জোচ্চুরি করতে না পেল, তা হলে জোচ্চুরিটা করবে কে, তুই-ই বল? তাই বলে অমন কথা! কম পাজি তো নয় লোকটা!
আপিসে সেদিন খুবই কাজের তাড়া ছিল, তবু তারই মধ্যে, থেকে থেকে জগদীশদা প্যান্টের পকেট চাপড়ে বার বার দেখেছিল কৌটো ঠিক আছে। অথচ ব্যাঙ্কে গিয়ে, পকেট থেকে পুটলি বের করে জগদীশদার চক্ষুস্থির! কোথায় গেল সেই শালুতে-মোড়া ঢাকনিতে দাওয়ালা সোনার কৌটো! এ যে একটা ন্যাকড়ায় জড়ানো কিমামের শিশি!