- বইয়ের নামঃ টং লিং
- লেখকের নামঃ লীলা মজুমদার
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১-০৫. এটার নাম পেরিস্তান
যে জায়গাটাতে আমি এখন বসে আছি এটার নাম পেরিস্তান। এ জায়গার কথা আমি ছাড়া এ বাড়ির কেউ জানেও না, এখানে কেউ আসতেও পারে না। ছোটোরা এখানে আসবার রাস্তাই খুঁজে পাবে না, আর বড়োদের পেট আটকে যাবে। কারণ, এক জায়গায় এ বাড়ির দেয়ালের কোনা আর পাশের গুদোমখানার দেয়ালের কোনা একেবারে ঘেঁষটে আছে। আর তার নীচে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে সরু অন্ধকার একটা নালা।
ভারি ভালো এ জায়গাটা, আঁকড়ে-মাকড়ে একবার পৌঁছুতে পারলে আর ভাবনা নেই, কেউ দেখতে পায় না। সামনে দিয়ে গঙ্গা বয়ে যাচ্ছে, আর মাথার বেশ খানিকটা ওপরে ওদের একতলার চাতাল, ওইখানেই ওদের নাটকের রিহার্সাল হচ্ছে এখন। ওদের পায়ের তলায় এই চমৎকার জায়গাটার কথা ওরা কেউ জানেও না। জানলে আর অমন নিশ্চিন্ত মনে হাত-পা নেড়ে নাটক করতে হত না!
সবচেয়ে খারাপ ওদের ওই প্রকাশদা, অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না। ওদিকে ক্লাস ইলেভেনে উঠেও বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক নেই, নাকি লট হয়েছেন। লট কী তা আমি ঠিক জানি না, তবে আমার বড়োকাকিমা যে-রকম করে বললেন, মনে হল নিশ্চয় খুব খারাপ কিছু।
ওই প্রকাশদা সাজছে শিশুপাল, আর ওদের ইস্কুলের অঙ্কের স্যার ব্রজেনদা সাজছে শ্রীকৃষ্ণ। ছোটোকাকা শেখাচ্ছেন– এমনি করে হাত বাড়িয়ে অর্ঘ্যথালা ধরে থাকো ব্রজেন, মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকো। ছোটোকাকা যা বলছেন ব্রজেনদা তাই করছে। ওদিকে প্রকাশদাকে পায় কে! বই দেখে দেখে খুব অপমান-টপমান করছে ব্রজেনদাকে। বইতে যেসব কথা নেই সেসবও ঢুকিয়ে দিচ্ছে। আমি পেছন থেকে বই দেখে যেমনি সেকথা বলেছি, কী রাগ আমার ওপর। আমার আর কী! এখন যতই অপমান করুক ব্রজেনদাকে, ওর অঙ্কের খাতা দেখবে ওই ব্ৰজেনদাই, তখন নাকি এক হাত নিয়ে নেবে। আমার বড়োকাকার ছেলে বিভুদা বলেছে।
বিভুদাও কম যায় না। আমাকে খালি খালি বলে,
–দ্যাখ, আমিই বলে কয়ে জ্যাঠামশাইকে– জ্যাঠামশাই মানে আমার বাবা চিঠি লিখিয়ে তোকে আনিয়েছি, এখন আমাদের এক বাক্স দাড়ি-গোঁফ না দিলে তোকে কিন্তু পার্ট দেওয়া হবে না।
শুনে আমি অবাক! এক বাক্স দাড়ি-গোঁফ আমি কোথায় পাব? বিভুদা কিছুতেই ছাড়ে না, বলে,
পাব না মানে? কলকাতার দোকানে সব পাওয়া যায়, গত বছরের ভূতুড়ে নাটকের জন্যে তো কলকাতা থেকেই হাড়গোড় ভাড়া করে আনা হয়েছিল। এবছর সব ঝগড়াঝাটির ব্যাপার, মোটে চাঁদা ওঠেনি, কলকাতা থেকে কিছু ভাড়া করে আনা যাবে না। ভালো চাস তো এক বাক্স দাড়ি-গোঁফ দে, নইলে ভোঁদার দল আমাদের ওপর এক হাত নেবে, এ আমি কিছুতেই সইব না বলে রাখলাম। দাড়ি-ঘোঁফ দেব না! ওঃ! ওই তালপাতার শরীরে তো তেজ কম না!!
এই বলে বিভুদা আমার ডান ঘাড়ে একটা রদ্দা মারল। মেরে বলল,
–এটাকে আমি মার বলি না, এটা শুধু মারের নমুনা। দাড়ি-গোঁফ না দিলে আসল মার কাকে বলে টের পাবি, বুঝলি চাঁদ!
বলে আমার গাল টেনে রবারের মতো এই অ্যাত্তখানি লম্বা করে দিল! শেষটা আমি এইখানে এই পেরিস্তানে চলে আসতে বাধ্য হলাম।
বিভুদা মনে ভাবে কী? ম্যালেরিয়া হয়ে নাহয় আমার শরীর খারাপই হয়ে গেছে, কিন্তু তাই বলে আমার বন্ধু বিশের তো আর ম্যালেরিয়া হয়নি। আসবে একটু বাদেই বিশে এখানে, হাঙরমুখো নৌকো বেয়ে ওপার থেকে। কী চালাক বিশে! এখানে পার হলে চাতাল থেকে ওরা দেখে নেবে, তাই গঙ্গার পুলের ওধারে পার হয়ে, নদীর কিনারা ঘেঁষে ঘেঁষে নৌকো চালিয়ে এসে ওই নালাটির ভেতর নৌকোসুদু ঢুকে পড়ে। ওখানে দেয়ালের গায়ে এই বড়ো আংটা লাগানো আছে, তাতে নৌকো বেঁধে বিশে এক লাফে নেমে পড়বে। সঙ্গেসঙ্গে গলার মধ্যে মেঘ ডাকার মতো শব্দ করতে করতে সিংহও লাফিয়ে নামবে।
সিংহ হল আমার বন্ধু বিশের কুকুর। কী চেহারা সিংহের, বাবা! দেখলেই লোকের হাত-পা হিম হয়ে যায়। আমি কিন্তু সিংহকে একটুও ভয় পাই না। ওর এত বড়ো কালো থ্যাবড়া নাকের ওপর হাত বুলিয়ে দিই, আর সিংহ ওর বুড়ো আঙুলের মতো ল্যাজ নেড়ে, নেচে-কুঁদে, আমার মুখ চেটে একাকার করে দেয়।
পোড়া হাঁড়ির মতো এত বড়ো সিংহের মুখটা, টকটকে লাল জিভ ঝুলিয়ে রাখে। কুকুরের ল্যাজ কেটে দিলে ওদের ভীষণ তেজ বাড়ে, তাই সিংহের ল্যাজটা বিশে বেশি করে কেটে দিয়েছে, তাতে খুব বেশি তেজ হয়েছে ওর।
আমার বন্ধু বিশের গায়ে কী জোর! এই এতখানি বুকের ছাতি, হাতের পায়ের গুলি ইটের মতো শক্ত। এতটুকু করে চুল ছাঁটা, তাতে নাকি কুস্তি করতে সুবিধে হয়। হাতাওয়ালা গেঞ্জি আর নীল হাফ-প্যান্ট আর সাদা ক্যাম্বিশের জুতো পরে বিশে যখন নৌকো থেকে লাফিয়ে নামে ওকে একটা পালোয়ানের মতো দেখায়! আমি মেজোকাকিমার কাছ থেকে চেয়ে আমসত্ত্ব নিয়ে আসি, বিশে এলে ভাগ করে খাই। সিংহও আমসত্ত্ব খায়।
আমরা তিন জনে চাতালের তলায় সবুজ ঘাসের ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে থাকি, আর গঙ্গার পুলের ওপর দিয়ে চেন ঝুলোতে ঝুলোতে মালগাড়ি যায় টং লিং–টং লিং–টং লিং। পায়ের তলায় তখন কীরকম লাগে যেন। মনে হয় অনেক দূরে কোথাও বিশের সঙ্গে চলে যাই।
বিশের বুকে একটা নীল রঙের কঙ্কালের মুণ্ডু আর তার নীচে দুটো মোটা মোটা মানুষের হাড় ক্রস করে বসানো, এইরকম করে উল্কি দিয়ে আঁকা আছে। দেখে প্রথমটা একটু কীরকম মনে হয়েছিল, ঠিক ভয় না, তবে পেটের ভেতরে প্রজাপতিরা ফড়ফড় করছিল। কিন্তু বিশে বললে,