- বইয়ের নামঃ ভোলগা থেকে গঙ্গা
- লেখকের নামঃ রাহুল সাংকৃত্যায়ন
- প্রকাশনাঃ ছায়াবীথি
- বিভাগসমূহঃ ইতিহাস
০১. নিশা (দেশ : ভোল্গা নদীর তীর ।। কাল ৬০০০ খৃষ্টপূর্ব)
বেলা দ্বিপ্রহর, অনেক দিন পরে আজ সূর্যের দেখা পাওয়া গেল। এখন দিনগুলি পাঁচ ঘন্টার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, তবুও এ সময় রোদের তীব্রতা নেই; মেঘঝঞ্চাহীন, তুষার ও কুয়াশামুক্ত সূর্যের সুদূরবিস্তারী কিরণ দেখতে মনোহ্তা–তার স্পর্শ এক আনন্দানুভূতির সঞ্চার করে। আর চারিদিকের দৃশ্য? ঘন নীল আকাশের নীচে পৃথিবী রয়েছে কর্পূরের মতো সাদা তুষারে ঢাকা। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে আর তুষারপাত না হওয়ার জন্য পূর্বের দানা-দানা তুষারকণাগুলি কঠিন জমাট হয়ে গেছে। এই হিমবসনা ধরিত্রী দিগন্তপ্রসারী নয়, বরং উত্তর থেকে দক্ষিণে কয়েক মাইল পর্যন্ত চলে গিয়েছে আঁকাবাঁকা রূপালী রেখার মত, যার দু’ধারে পাহাড়ের উপর নিবিড় অরণ্যরেখা। আসুন, এই বনরাজিকে আরও কাছে গিয়ে দেখি। এই তরুশ্রেণীর মধ্যে মূলত দুই ধরনের বৃক্ষাদি আছে। একটির নাম ভুর্জ-শ্বেত বল্কলধারী এবং বর্তমানে নিষ্পত্র; অপরটি পাইন-উত্তুঙ্গ ও ঋজু। শাখাগুলি সমকোণে ছড়িয়ে গেছে চারিদিকে। সূচ্যগ্র পাতাগুলি হরিৎ বর্ণ-কোনোটা ঘন গাঢ় সবুজ আর কোনোটা ফিকে। তুষারের অজস্র দান থেকে গাছগুলি নিষ্কৃতি পায়নি, গাছের কোণে তুষারের স্তূপ সাদা কালোয় রূপ-রেখা সৃষ্টি করে কার যে দৃষ্টি আকর্ষণ করছে! এ ছাড়া চারিদিকে ভয়ঙ্কর নীরবতার অখণ্ড রাজত্ব বিদ্যমান। কোনোদিক থেকেই শোনা যায় না ঝিঁঝির ঝঙ্কার, পাখীর কাকলী বা পশুর কোলাহল।
আসুন, পাহাড়ের সর্বোচ্চ শিখরস্থিত পাইন গাছের ওপর উঠে চারিদিকটা দেখি। হয়ত ওখানে গেলে বরফ, জমি ও পাইন ছাড়া আরও কিছু দেখতে পাওয়া যেতে পারে। বড় বড় বৃক্ষরাজির দিকে তাকিয়ে মনে হতে পারে যে এখানে কি কেবল এ রকম গাছই জন্মায়? এই জমিতে কি ছোট ছোট চারা গাছ বা ঘাস জন্মায় না? কিন্তু সে সম্বন্ধে আমরা কোনো মতামত দিতে পারি না। শীত প্রায় শেষ হয়ে এল। এই বড় বড় গাছের গুঁড়িগুলি কতখানি বরফের স্তুপে ঢাকা পড়েছে তা বলা শক্ত, আমাদের কাছে মাপবার কিছু নেই। এই বরফের স্তূপ আট হাত অথবা তার চেয়েও বেশি হতে পারে। বরফ এ বছর বেশি পড়েছে–এ অভিযোগ সকলেরই।
পাইনের ওপরে এসে কি দেখা যাচ্ছে? দেখছি সেই বরফ, সেই বনরাজি আর সেই উঁচু-নীচু পার্বত্য-ভূমি। হ্যাঁ, পাহাড়ের অপর পারে এক জায়গায় ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। জনপ্রাণী-শব্দশূণ্য বনভূমির মধ্যে ধোঁয়ার কুণ্ডলী কৌতুহল জাগিয়ে তোলে। আসুন ওখানে গিয়ে নিজেদের কৌতূহল মিটিয়ে আসি।ত
ধোঁয়া অনেক দূর। স্বচ্ছ মেঘশূণ্য আকাশের পটভূমিতে কত কাছেই না মনে হচ্ছিল। যাই হোক, হাঁটতে হাঁটতে আমরা তার কাছে পৌঁছে গেছি, গন্ধ পাচ্ছি আগুনে পোড়া চর্বি আর মাংসের। শব্দও শোনা যাচ্ছে–শোনা যাচ্ছে শিশুদের কলরব। আমাদের খুব সাবধানে শ্বাস বন্ধ করে পা টিপে টিপে যেতে হবে। না হলে ওরা জানতে পারবে! জানতে পারলে–কে জানে, ওরা কিম্বা ওদের কুকুরগুলো কি রকম অভ্যর্থনা করবে!
হ্যাঁ, সত্যি সত্যিই ছোট ছোট শিশুরা রয়েছে–এক থেকে আট বছরের মধ্যে এদের বয়স! একটি ঘরের মধ্যে জনা ছয়েক ছোট ছেলেমেয়ে। একে ঠিক ঘর বলা যায় না — স্বাভাবিক পর্বতগুহা মাত্র। এই গুহাগৃহের পাশে ও পেছনে কতদূর পর্যন্ত অন্ধকার বিস্তৃত জানি না, আর জানার চেষ্টা করাও উচিত নয়! পূর্ণবয়স্ক একটি বৃদ্ধাকে দেখা যাচ্ছে–তার জটাধরা ধোঁয়াটে শনের মতো সাদা চুলগুলি এলোমেলোভাবে মুখে এসে পড়ছে, বুড়ি হাত দিয়ে মাঝে মাঝে মুখ থেকে সেগুলি সরিয়ে দিচ্ছে। ভুরুত চুলগুলিও পেকে সাদা রঙ ধরছে। সাদা মুখের চামড়া কুঁচকে জায়গায় জায়গায় ঝুলে পড়েছে, গুহার ভেতরে আগুনের তাপ ও ধোঁয়া দুই আছে– বিশেষ করে যেখানে আছে শিশুগুলি ও তাদের দিদিমা। মাতামহীর দেহে কোন আবরণ নেই, নেই কোন কাপড়-চোপড়ের বালাই! শীর্ণ কঙ্কালসার হাত দুটি পায়ের কাছে মাটিতে পড়ে আছে, চোখ কোটরাগত, ফিকে নীল চোখ দুটি তার জ্যোতিহীন, কিন্তু মাঝে মাঝে ঝক্মক করে ওঠে, এতে মনে হয় এগুলি এখনো একেবারে নিষ্প্রভ হয় নি। কান দুটি তো খুবই সজাগ। মনে হচ্ছে দিদিমা যেন শিশুদের কথা মন দিয়ে শুনছে। এইমাত্র একটি শিশু চীৎকার করে উঠল, দিদিমা সেদিকে তাকাল। এক বছর ও দেড় বছরের দুটি শিশু, মাথায় দু’জনেই সমান। দু’জনেরই চুল পিঙ্গল বর্ণ। এদের চুলের রঙ বৃদ্ধার চেয়ে আরো সুন্দর ও উজ্জ্বল। এদের নধরকান্তি দেহ, দুধে আলতায় রঙ, বড় বড় চোখ, ঘন নীল তারা। ছেলেটি চীৎকার করে কাঁদছে, মেয়েটি দাঁড়িয়ে চুষিকাঠির মতো একটি হাড় চুষছে।
দিদিমা কম্পিত স্বরে ডাকল, “অগিন! আয়। এখানে আয় অগিন! এই যে তোর দিদি এখানে।”
অগিল উঠল না। একটি বছর আটেকের ছেলে এসে অগিনকে কোলে করে মাতামহীর কাছে নিয়ে গেল। এই ছেলেটিরও চুল অন্যদের মতো উজ্জ্বল স্বর্ণাভ তবে কিছু বেশি লম্বা এবং জট পাকানো। দেহের বর্ণ গৌর, তবে শিশুদের মতো পরিপুষ্ট নয়। গায়ের এখানে ওখানে ময়লা জমে আছে। ছেলেটি ছোট শিশুটিকে এনে মাতামহীর কাছে দাঁড় করিয়ে বলল, “দাদী! রোচনা হাড় কেড়ে নিয়েছে, অগিন তাই কাঁদছে।”
ছেলেটি এই বলে চলে গেল। মাতামহী তার শীর্ণ হাতে শিশুটিকে তুলে নিল। অগিন তখনও কাঁদছিল। তার চোখের জলের ধারায় গালের ময়লা কেটে গিয়েছে, সেখানে উঁকি মারছে গৌরবর্ণের ওপরে সোনালী রেখা। মাতামহী অগিনের মুখে একটি চুমু খেয়ে বলল, “অগিন! কেঁদো না, আমি রোচনাকে মারছি।”
এই বলে মাতামহী খালি হাতটা চর্বিমাখা মাটির ওপর আঘাত করল। অগিনের কান্না তখনও থামেনি, চোখের জলও ফুরোয়নি। মাতামহী তার ময়লা হাত দিয়ে অগিনের মুখ মুছিয়ে দিলে–তার হাতের ময়লাতে শিশুর রক্তাভ গাল কালো হয়ে গেল। অগিনকে শান্ত করার জন্য মাতামহী তার নিজের শুকনো স্তনটি মুখে তুলে দিল। অগিনের কান্না বন্ধ হল, সে মাতামহীর স্তন চুষতে লাগল। এই সময় বাইরে কথাবার্তা শোনা গেল। শিশুটি শুকনো স্তন ছেড়ে সেইদিকে তাকাল।
কার যেন মিষ্টি গলার স্বর–“অ-গি-ই-ন!”
অগিন আবার কেঁদে উঠল। দুটি স্ত্রীলোক একটি কোণের দিকে তাদের মাথা থেকে কাঠের বোঝা ফেলে একজন রোচনার কাছে অপরজন অগিনের কাছে ছুটে গেল। ক্রন্দনরত অগিন আরো জোরে চেঁচিয়ে উঠল “মা” “মা” বলে। মা তার ডান হাতটি খালি রেখে ডানদিকের স্তনের ওপর থেকে লোমযুক্ত বলদের চামড়ার আবরণটি খুলে ফেলল। শীতের দিনে খাওয়া-দাওয়া ভালো নেই বলে তরুণীর দেহ যথেষ্ট মাংসল নয়, কিন্তু সৌন্দর্যে অসাধারণ। ময়লাহীন আরক্তিম গালের উজ্জ্বল আভা, জটাবিহীন সোনালী কেশদাম, তন্বী দেহ, পরিপুষ্ট বুকের ওপর গোল গোল শ্যামল– মুখ স্তন, কৃশ কটি, আকর্ষণীয় নিতম্ব, পরিপুষ্ট পেশল জানু, পরিশ্রমে গড়ে ওঠা পায়ের ডিম। সেই অষ্টাদশী তরুণী অগিনকে দু’হাতে তুলে তার মুখ চোখ গাল অজস্র চুমুতে ভরে দিল। অগিন কান্না ভুলে গেল। তার দুটি রক্তাভ ঠোঁটের আড়ালে কচি দাঁতগুলি চিক্-চিক্ করছে, চোখ দুটি আধ-বোঁজা, গালে টোল পড়েছে। একটি বৃষভ-চর্মের ওপর বসে তরুণী তার কোমল স্তনটি তুলে দিল অগিনের মুখ। এই সময় তরুণীটিও রোচনকে নিয়ে তার কাছে উপবেশন করল, দেখলেই বোঝা যায় ওরা দু’জন সহোদরা।