- বইয়ের নামঃ ভারতবর্ষ
- লেখকের নামঃ রমাপদ চৌধুরী
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
ভারতবর্ষ
ফৌজি সংকেতে নাম ছিল বি এফ থ্রি থার্টি টু BF 3321 সেটা আদপে কোনো স্টেশনই ছিলো না, না প্ল্যাটফর্ম না টিকিটঘরা শুধু একদিন দেখা গেল ঝকঝকে নতুন কাঁটাতার দিয়ে রেল লাইনের ধারটুকু ঘিরে দেওয়া হয়েছে। ব্যস, ঐটুকুই। সারা দিনে আপ-ডাউনের একটা ট্রেনও থামতো না। থামতো শুধু একটি বিশেষ ট্রেন। হঠাৎ এক-একদিন সকালবেলায় এসে থামতো। কবে কখন সেটা থামবে, তা শুধু আমরাই আগে থেকে জানতে পেতাম, বেহারী কুক ভগোতীলালকে নিয়ে আমরা পাঁচজন।
স্টেশন ছিলো না, ট্রেন থামতো না, তবু রেলের লোকদের মুখে মুখে একটা নতুন নাম চালু হয়ে গিয়েছিলো। তা থেকে আমরাও বলতাম ‘আন্ডা হল্ট’।
আন্ডা মানে ডিম। আন্ডা হল্টের কাছ ঘেঁষে দুটো বেঁটেখাটো পাহাড়ী টিলার পায়ের নীচে একটা মাহাতোদের গ্রাম ছিললা, গ্রামে-ঘরে মুর্গি চরে বেড়াতো দূরে, অনেক দূরে ভুরকুণ্ডার শনিচারী হাটে সেই মুর্গি কিংবা মুর্গির ডিম বেচতেও যেতো মাহাতোরা। কখনো সাধের মোরগ বগলে চেপে মোরগ-লড়াই খেলতে যেতো। কিন্তু সেজন্য বি এফ থ্রি থার্টি টু-র নাম আন্ডা হল্ট হয়ে যায়নি।
আসলে মাহাতো-গাঁয়ের ডিমের ওপর আমাদের কোনো লোভই ছিলো না।
আমাদের ঠিকাদারের সঙ্গে রেলওয়ের ব্যবস্থা ছিল, একটা ঠেলা-ট্রলিও ছিলো তার, লাল শালু উড়িয়ে সেটা রেলের ওপর দিয়ে গড়িয়ে এসে মালপত্র নামিয়ে দিয়ে যেতো। নামিয়ে দিয়ে যেতো রাশি রাশি ডিম। বেহারী কুক ভগোতীলাল আগের রাত্রে সেগুলো সেদ্ধ করে রাখতো।
কিন্তু সেজন্যেও নাম আন্ডা হল্ট হয়নি। হয়েছিল ফুল-বয়েলড ডিমের খোসা কাঁটাতারের ওপারে ক্রমশ স্তূপীকৃত হয়ে জমেছিলো বলে। ডিমের খোসা দিনে দিনে পাহাড় হচ্ছিল বলে।
ফৌজী ভাষার বি এফ থ্রি থার্টি টু-র প্রথমেই যে দুটো অ্যালফাবেট, আমাদের ধারণা ছিলো তা কোনো সংকেত নয়, ব্রেকফাস্ট কথাটার সংক্ষিপ্ত রূপা।
রামগড়ে তখন পি ও ডবলু ক্যাম্প, ইটালীয়ান যুদ্ধবন্দীরা সেখানে বেয়নেটে আর কাঁটাতারে ঘেরা। তাদেরই মাঝে মাঝে একটা ট্রেনে বোঝাই করে এ পথ দিয়ে কোথায় যেন চালান করে দিতো। কেন এবং কোথায়, আমরা কেউ জানতাম না।
শুধু আমরা খবর পেতাম ভোরবেলায় একটা ট্রেন এসে থামবে। ঠিকাদারের চিঠি পড়ে আগের দিন ডিমের ঝুড়িগুলো দেখিয়ে কুক ভগোতীলালকে বলতাম, তিন সোতিশ ব্রেকফাস্ট।
ভগোতীলাল গুনে গুনে ছ’শো ষাট আর গোটা পঁচিশ ফাউ বের করে নিতো। যদি পচা বের হয়। তারপর সেগুলো জলে ফুটিয়ে শক্ত হঁট হয়ে গেলে তিনটে সার্ভার কুলির সঙ্গে হাত মিলিয়ে খোসা ছাড়াতো।
কাঁটাতারের ওপারে সেগুলোই দিনে দিনে স্তূপীকৃত হতো।
সক্কালবেলায় ট্রেন এসে থামতো, আর সঙ্গে সঙ্গে কামরা থেকে ট্রেনের দু পাশে ঝুপঝাপ নেমে পড়তো মিলিটারী গার্ডা সঙ্গিন উঁচু করা রাইফেল নিয়ে তারা যুদ্ধবন্দীদের পাহারা দিতো।
ডোরাকাটা পোশাকের বিদেশী বন্দীরা একে একে কামরা থেকে নেমে আসতো বড়সড় মগ আর এনামেলের থালা হাতে
দুটো বড় বড় ড্রাম উলটে রেখে সে দুটোকেই টেবিল বানিয়ে সার্ভার কুলি তিনজন দাঁড়াতে আর ওরা লাইন দিয়ে একে একে এগিয়ে এসে ব্রেকফাস্ট নিতো। একজন কফি ঢেলে দিতো মগে, একজন দু পিস করে পাঁউরুটি দিতো, আরেকজন দিততা দুটো করে ডিম। ব্যস, তারপর ওরা গিয়ে গাড়িতে উঠতো। কাঁধে আই. ই. খাকী বুশ-সার্ট পরা গার্ড হুইসল দিতো, ফ্লাগ নাড়তো, ট্রেন চলে যেতো।
মাহাতোরা কেউ কাছে আসতো না, দূরে দূরে ক্ষেতিতে জনারের বীজ রুইতে রুইতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে দেখতো।
ট্রেন চলে যাওয়ার পরে ভগোতীলালের জিম্মায় টেস্ট রেখে আমরা কোনো কোনো দিন মাহাতোদের গ্রামের দিকে চলে যেতাম সবজির খোঁজে। পাহাড়ের ঢালুতে পাথুরে জমিতে ওরা সর্ষে বুনতো, বেগুন আর ঝিঙেও।
আন্ডা হল্ট একদিন হল্ট-স্টেশন হয়ে গেল রাতারাতি। মোরম ফেলে লাইনের ধারে কাঁটাতারে ঘেরা জায়গাটুকু উঁচু করা হলো প্ল্যাটফর্মের মতো।
তখন আর শুধু পি ও ডবলু নয়, মাঝে মাঝে মিলিটারী স্পেশালও এসে দাঁড়াতো। গ্যাবার্ডিনের প্যান্ট পরা হিপ পকেটে টাকার ব্যাগ গোঁজা আমেরিকান সৈনিকদের স্পেশাল মিলিটারী পুলিশ ট্রেন থেকে নেমে পায়চারি করতো, দু-একটা ঠাট্টাও ছুঁড়তো, আর সৈনিকের দল তেমনি সারি দিয়ে মগ আর থালা হাতে একে একে রুটি নিতো, ডিম নিতো, মগভরতি কফি। তারপরে যে যার কামরায় আবার উঠতো, খাকী বুশ-শার্টের গার্ড হুইসল বাজিয়ে ফ্লাগ নাড়তো, আমি ছুটে গিয়ে সাপ্লাই ফর্মে মেজরকে দিয়ে ও. কে. করাতাম।
ট্রেন চলে যেতো, কোথায় কোন দিকে আমরা কেউ জানতে পারতাম না।
সেদিনও এমনি আমেরিকান সোলজারদের ট্রেন এসে দাঁড়াল। সার্ভার কুলি তিনটে ডিম রুটি কফি সার্ভ করছিলো। ভগোতীলাল নজর রাখছিলো কেউ ডিম পচা কিংবা রুটি স্লাইস-এন্ড বলে। ছুঁড়ে দেয় কি না।
ঠিক সেই সময় আমার হঠাৎ চোখ গেল কাঁটাতারের বেড়ার ওধারে।
কাঁটাতার থেকে আরো খানিক দূরে মাহাতোদের একটি নেংটি-পরা ছেলে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে দেখছে। কোমরের ঘুনসিতে লোহার টুকরো বাঁধা ছেলেটাকে একটা বাচ্চা মোষের পিঠে বসে যেতে দেখেছি একদিন।