- বইয়ের নামঃ লিলুয়া বাতাস
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
আমার বড়খালা কিছুদিন হলো ভূত দেখছেন
আমার বড়খালা কিছুদিন হলো ভূত দেখছেন। ঠাট্টা না, সত্যি! ভূতগুলি তাঁর শোবার ঘরের চিপায় চাপায় থাকে। তাকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করে। তিনি ধমক দিয়ে তাদের বের করে দেন। এই তো কিছুক্ষণ আগের কথা, আমি আমার ঘরে বসে জুতা ব্রাস করছি (আমার জুতা না, বাবার জুতা। তিনি আয়নার মতো ঝকঝকে জুতা ছাড়া পায়ে দেন না), তখন শুনলাম বড়খালা কাকে যেন ধমকাচ্ছেন। চাপা গলায় ধমক। আমি জুতা হাতেই বড়খালার ঘরে ঢুকে দেখি তিনি খাটের সামনে উবু হয়ে বসে আছেন। তাঁর হাতে একটা শলার ঝাড়। তিনি ঝাড় নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলছেন, বের হ বলছি। বের হ। পুলাপান ভর্তি বাড়ি! তুই এদের ভয় দেখাবি? ঝাড় মেরে আজ তোর বিষ নামায়ে দেব। বদমাশ!
আমি বললাম, কার সঙ্গে কথা বলছ?
বড়খালা বললেন, বাবলু, জুতা দিয়ে তুই এর গালে একটা বাড়ি দে তো। এমন বাড়ি দিবি যেন এর চাপার দাঁত নড়ে যায়। বদমাইশটা খাটের নিচে।
আমি খাটের নিচে উঁকি দিলাম। দুটা ট্রাংক, একজোড়া স্যান্ডেল, একটা টিফিন কেরিয়ার এবং প্লাস্টিকের ছোট লাল বালতি ছাড়া আর কিছু নেই। আমি বললাম, খালা, কিছু দেখছি না তো।
খালা স্বাভাবিক গলায় বললেন, চলে গেছে! এর ভাগ্য ভালো। জুতার বাড়ি খাওয়ার আগেই গেছে।
আমি বললাম, জিনিসটা কী?
খালা চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, পিচকা ভূতটা। এইটাই বদের হাড্ডি। বাবলু, টিভিটা ছাড় তো। আর পিছনের পর্দা টেনে দে। তোর মাকে বল আমাকে কড়া করে যেন এক কাপ চা দেয়। চিনি কম দিতে বলবি। এরা চা ঠিকমতো বানাতে পারে না। আধা কাপ চায়ে চিনি দেয় তিন চামচ। এক চুমুক দিলে কলিজা পর্যন্ত মিষ্টি হয়ে যায়।
আমার খালার নাম মাজেদা বেগম। গত সাত বছর ধরে তিনি এবং তার বড়ছেলে জহির আমাদের সঙ্গে থাকেন। খালার স্বভাবে আচার-আচরণে কোনো রকম অস্বাভাবিকতা নেই। শুধু মাঝে-মধ্যে ভূত দেখেন, এই ভূত দেখার মধ্যেও কোনো বাড়াবাড়ি নেই। হৈচৈ চিৎকার নেই। যেন ভূত-প্রেতের দেখা পাওয়া মানব জীবনের স্বাভাবিক ঘটনার একটি।
খালার সময় কাটে টিভিতে হিন্দি সিরিয়াল দেখে এবং পুরনো ম্যাগাজিন পড়ে। নতুন ম্যাগাজিন তিনি পড়তে পারেন না। আমি একবার তাকে দুটা নতুন সিনেমা ম্যাগাজিন কিনে এনে দিয়েছিলাম। তিনি পড়েন নি। খাটের পাশে রেখে দিয়েছিলেন। কেউ আগে পড়বে, ময়লা করবে, পাতা কুঁচকাবে, তারপর তিনি পড়বেন। তার আগে না।
এটাকে তাঁর চরিত্রের অস্বাভাবিকতা বলা ঠিক হবে না। নতুন ম্যাগাজিন তিনি পড়তে পারেন না, কারণ খালু সাহেব এই বিষয়টা পছন্দ করতেন না। ম্যাগাজিন, খবরের কাগজ তিনি আগে পড়তেন, তারপর অন্যরা পড়তে পারত। ভুলে কেউ যদি তার আগে খবরের কাগজ পড়ে ফেলত, তিনি চিৎকার চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলতেন। নতুন খবরের কাগজ কিনিয়ে আনতেন, আগেরটা ছুঁয়ে দেখতেন না।
খালু সাহেব (মিজানুর রহমান খান, চাটার্ড অ্যাকাউনটেন্ট) রোড অ্যাকসিডেন্টে সাত বছর আগে মারা গেছেন। কিন্তু তার তৈরি করা নিয়মকানুন বড়খালার মধ্যে রেখে গেছেন। ঐ যে কবিতাটা আছে না— পাখি উড়ে চলে গেলে পাখির পালক পড়ে থাকে। খালু সাহেব উড়ে চলে গেছেন, কিন্তু পুরনো ম্যাগাজিন রেখে গেছেন।
খালু সাহেবের ব্যাপারটা পরে বলব, আগে বড়খালার বিষয়টা শেষ করি। আগেই বলেছি, বড়খালার বয়স পঞ্চাশের ওপর। কিন্তু বয়সের কোনো দাগ তার চেহারায় পড়ে নি। মোটাসোটা থলথলে একজন মানুষ। সুখী সুখী চোখমুখ। জর্দা দিয়ে পান খেতে পছন্দ করেন। সব ধরনের জর্দা না, ময়মনসিংহের মিকচার জর্দা কিংবা ইন্ডিয়ান গোপাল জর্দা। জর্দা খাবার সময় পানের রস তার থুতনি গড়িয়ে প্রায় পড়ে পড়ে যখন হয় তখন তিনি শো করে টেনে সেই রস মুখে নিয়ে নেন। এই দৃশ্যটা খুব সুন্দর।
তাঁর গায়ের রঙ ফর্সা, মেমসাহেবদের মতো ফর্সা। মেমসাহেবদের স্বভাবের সঙ্গেও তার মিল আছে। তিনিও মেমসাহেবদের মতো গরম সহ্য করতে পারেন না। শীতের সময়ও তার ঘরে এসি চলে। (একমাত্র বড়খালার ঘরেই এসি আছে। এরিস্টন কোম্পানির দেড়টনি এসি। যখন চলে ভোঁ ভোঁ শব্দ হয়। মনে হয় ভোমরা উড়ছে।)
দিনরাত এসি চলার কারণে তাঁর ঘর ফ্রিজের ভেতরের মতো ঠাণ্ডা হয়ে থাকে। তারপরেও তার গরম যায় না। তিনি কোনোমতে একটা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে রাখেন। শাড়ির নিচে পেটিকোট-ব্লাউজ কিছুই পরেন না। সেই শাড়িও যে সবসময় গায়ে লেপ্টে থাকে তা-না। উপরের অংশ যখন-তখন নেমে কোমরের কাছে চলে আসে। বড়খালা তা নিয়ে মাথা ঘামান না। আমাদের বাড়ির সবাই বড়খালাকে এই অবস্থায় অনেকবার দেখেছে। সবচে বেশি দেখেছি আমি। বয়সে ছোট বলে বড়খালা কখনো আমাকে গুনতির মাঝেই ধরতেন না। এখন আমি বড় হয়েছি। এইবার এসএসসি দেব। এখনো তিনি আমাকে গুনতিতে ধরেন না।
বড়খালার গরম বিষয়ক জটিলতার সঙ্গে আমরা পরিচিত বলে আমাদের কাছে বড়খালার ‘অর্ধনগ্ন’ সমস্যা কোনো সমস্যা না। বাড়িতে নতুন লোকজন এলে তারা ঝামেলায় পড়ে। কাজের মেয়ে জিতুর মা আমাদের বাড়িতে প্রথম কাজ করতে এসেই চোখ কপালে তুলে বলল, ও আল্লা, দোতলার ঘরে এক বেটি নেংটা হইয়া বইসা আছে?
বাবা তখন নাশতা খাচ্ছিলেন। তিনি টেবিল থেকে উঠে এসে হুঙ্কার দিয়ে বললেন, হোয়াট! এত বড় কথা। তুমি কানে ধর। কানে ধরে দশবার উঠবোস কর।