- বইয়ের নামঃ পূজা
- লেখকের নামঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- বিভাগসমূহঃ রবীন্দ্রসংগীত
অকারণে অকালে মোর পড়ল যখন ডাক
অকারণে অকালে মোর পড়ল যখন ডাক
তখন আমি ছিলেম শয়ন পাতি।
বিশ্ব তখন তারার আলোয় দাঁড়ায়ে নির্বাক,
ধরায় তখন তিমিরগহন রাতি।
ঘরের লোকে কেঁদে কইল মোরে,
“আঁধারে পথ চিনবে কেমন ক’রে?’
আমি কইনু, “চলব আমি নিজের আলো ধরে,
হাতে আমার এই-যে আছে বাতি।’
বাতি যতই উচ্চ শিখায় জ্বলে আপন তেজে
চোখে ততই লাগে আলোর বাধা,
ছায়ায় মিশে চারি দিকে মায়া ছড়ায় সে-যে–
আধেক দেখা করে আমায় আঁধা।
গর্বভরে যতই চলি বেগে
আকাশ তত ঢাকে ধুলার মেঘে,
শিখা আমার কেঁপে ওঠে অধীর হাওয়া লেগে–
পায়ে পায়ে সৃজন করে ধাঁধা ॥
হঠাৎ শিরে লাগল আঘাত বনের শাখাজালে,
হঠাৎ হাতে নিবল আমার বাতি।
চেয়ে দেখি পথ হারিয়ে ফেলেছি কোন্ কালে–
চেয়ে দেখি তিমিরগহন রাতি।
কেঁদে বলি মাথা করে নিচু,
“শক্তি আমার রইল না আর কিছু!’
সেই নিমেষে হঠাৎ দেখি কখন পিছু পিছু
এসেছ মোর চিরপথের সাথি ॥
অগ্নিবীণা বাজাও তুমি কেমন ক’রে
অগ্নিবীণা বাজাও তুমি কেমন ক’রে!
আকাশ কাঁপে তারার আলোর গানের ঘোরে ॥
তেমনি ক’রে আপন হাতে ছুঁলে আমার বেদনাতে,
নূতন সৃষ্টি জাগল বুঝি জীবন-‘পরে ॥
বাজে ব’লেই বাজাও তুমি সেই গরবে,
ওগো প্রভু, আমার প্রাণে সকল সবে।
বিষম তোমার বহ্নিঘাতে বারে বারে আমার রাতে
জ্বালিয়ে দিলে নূতন তারা ব্যথায় ভ’রে ॥
অচেনাকে ভয় কী আমার ওরে
অচেনাকে ভয় কী আমার ওরে ?
অচেনাকেই চিনে চিনে উঠবে জীবন ভরে॥
জানি জানি আমার চেনা কোনো কালেই ফুরাবে না,
চিহ্নহারা পথে আমায় টানবে অচিন ডোরে॥
ছিল আমার মা অচেনা, নিল আমায় কোলে।
সকল প্রেমই অচেনা গো, তাই তো হৃদয় দোলে।
অচেনা এই ভুবন-মাঝে কত সুরেই হৃদয় বাজে–
অচেনা এই জীবন আমার,
বেড়াই তারি ঘোরে॥
অনিমেষ আঁখি সেই কে দেখেছে
অনিমেষ আঁখি সেই কে দেখেছে
যে আঁখি জগতপানে চেয়ে রয়েছে॥
রবি শশী গ্রহ তারা হয় নাকো দিশাহারা,
সেই আঁখি ’পরে তারা আঁখি রেখেছে॥
তরাসে আঁধারে কেন কাঁদিয়া বেড়াই,
হৃদয়-আকাশ-পানে কেন না তাকাই ?
ধ্রুবজ্যোতি সে নয়ন জাগে সেথা অনুক্ষণ,
সংসারের মেঘে বুঝি দৃষ্টি ঢেকেছে॥
অনেক দিনের শূন্যতা মোর ভরতে হবে
অনেক দিনের শূন্যতা মোর ভরতে হবে
মৌনবীণার তন্ত্র আমার জাগাও সুধারবে ॥
বসন্তসমীরে তোমার ফুল-ফুটানো বাণী
দিক পরানে আনি–
ডাকো তোমার নিখিল-উৎসবে ॥
মিলনশতদলে
তোমার প্রেমের অরূপ মূর্তি দেখাও ভুবনতলে।
সবার সাথে মিলাও আমায়, ভুলাও অহঙ্কার,
খুলাও রুদ্ধদ্বার
পূর্ণ করো প্রণতিগৌরবে ॥
অনেক দিয়েছ নাথ
অনেক দিয়েছ নাথ,
আমায় অনেক দিয়েছ নাথ,
আমার বাসনা তবু পুরিল না–
দীনদশা ঘুচিল না, অশ্রুবারি মুছিল না,
গভীর প্রাণের তৃষা মিটিল না, মিটিল না ॥
দিয়েছ জীবন মন, প্রাণপ্রিয় পরিজন,
সুধাস্নিগ্ধ সমীরণ, নীলকান্ত অম্বর, শ্যামশোভা ধরণী।
এত যদি দিলে, সখা, আরো দিতে হবে হে–
তোমারে না পেলে আমি ফিরিব না, ফিরিব না ॥
অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে
অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে–
নির্মল করো, উজ্জ্বল করো, সুন্দর করো হে ॥
জাগ্রত করো, উদ্যত করো, নির্ভয় করো হে।
মঙ্গল করো, নিরলস নিঃসংশয় করো হে ॥
যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে, মুক্ত করো হে বন্ধ।
সঞ্চার করো সকল কর্মে শান্ত তোমার ছন্দ।
চরণপদ্মে মম চিত নিষ্পন্দিত করো হে।
নন্দিত করো, নন্দিত করো, নন্দিত করো হে ॥
অন্তরে জাগিছ অন্তরযামী
অন্তরে জাগিছ অন্তরযামী।
তবু সদা দূরে ভ্রমিতেছি আমি ॥
সংসার সুখ করেছি বরণ,
তবু তুমি মম জীবনস্বামী ॥
না জানিয়া পথ ভ্রমিতেছি পথে
আপন গরবে অসীম জগতে।
তবু স্নেহনেত্র জাগে ধ্রুবতারা,
তব শুভ আশিস আসিছে নামি ॥
অন্ধকারের উৎস-হতে উৎসারিত আলো
অন্ধকারের উৎস-হতে উৎসারিত আলো
সেই তো তোমার আলো!
সকল দ্বন্দ্ববিরোধ-মাঝে জাগ্রত যে ভালো
সেই তো তোমার ভালো ॥
পথের ধুলায় বক্ষ পেতে রয়েছে যেই গেহ
সেই তো তোমার গেহ।
সমরঘাতে অমর করে রুদ্রনিঠুর স্নেহ
সেই তো তোমার স্নেহ ॥
সব ফুরালে বাকি রহে অদৃশ্য যেই দান
সেই তো তোমার দান।
মৃত্যু আপন পাত্রে ভরি বহিছে যেই প্রাণ
সেই তো তোমার প্রাণ।
বিশ্বজনের পায়ের তলে ধূলিময় যে ভূমি
সেই তো স্বর্গভূমি।
সবায় নিয়ে সবার মাঝে লুকিয়ে আছ তুমি
সেই তো আমার তুমি ॥
অন্ধকারের মাঝে আমায় ধরেছ দুই হাতে
অন্ধকারের মাঝে আমায় ধরেছ দুই হাতে।
কখন্ তুমি এলে, হে নাথ, মৃদু চরণপাতে?।
ভেবেছিলেম, জীবনস্বামী, তোমায় বুঝি হারাই আমি–
আমায় তুমি হারাবে না বুঝেছি আজ রাতে ॥
যে নিথীথে আপন হাতে নিবিয়ে দিলেম আলো
তারি মাঝে তুমি তোমার ধ্রুবতারা জ্বালো।
তোমার পথে চলা যখন ঘুচে গেল, দেখি তখন
আপনি তুমি আমার পথে লুকিয়ে চল সাথে ॥
অন্ধজনে দেহো আলো
অন্ধজনে দেহো আলো, মৃতজনে দেহো প্রাণ–
তুমি করুণামৃতসিন্ধু করো করুণাকণা দান ॥
শুষ্ক হৃদয় মম কঠিন পাষাণসম,
প্রেমসলিলধারে সিঞ্চহ শুষ্ক নয়ান ॥
যে তোমারে ডাকে না হে তারে তুমি ডাকো-ডাকো।
তোমা হতে দূরে যে যায় তারে তুমি রাখো রাখো।
তৃষিত যেজন ফিরে তব সুধাসাগরতীরে
জুড়াও তাহারে স্নেহনীরে, সুধা করাও হে পান ॥
তোমারে পেয়েছিনু যে, কখন্ হারানু অবহেলে,
কখন্ ঘুমাইনু হে, আঁধার হেরি আঁখি মেলে।
বিরহ জানাইব কায়, সান্ত্বনা কে দিবে হায়,
বরষ বরষ চলে যায়, হেরি নি প্রেমবয়ান–
দরশন দাও হে, দাও হে দাও, কাঁদে হৃদয় ম্রিয়মাণ ॥