- বইয়ের নামঃ বিচিত্র
- লেখকের নামঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- বিভাগসমূহঃ রবীন্দ্রসংগীত
আঁধারের লীলা আকাশে
আঁধারের লীলা আকাশে আলোকলেখায়-লেখায়,
ছন্দের লীলা অচলকঠিনমৃদঙ্গে।
অরূপের লীলা অগোনা রূপের রেখায় রেখায়,
স্তব্ধ অতল খেলায় তরলতরঙ্গে॥
আপনারে পাওয়া আপনা-ত্যাগের গভীর লীলায়,
মূর্তির লীলা মূর্তিবিহীন কঠোর শিলায়,
শান্ত শিবের লীলা যে প্রলয়ভ্রূভঙ্গে।
শৈলের লীলা নির্ঝরকলকলিত রোলে,
শুভ্রের লীলা কত-না রঙ্গে বিরঙ্গে।
মাটির লীলা যে শস্যের বায়ুহেলিত দোলে,
আকাশের লীলা উধাও ভাষার বিহঙ্গে।
স্বর্গের খেলা মর্তের ম্লান ধুলায় হেলায়,
দুঃখেরে লয়ে আনন্দ খেলে দোলন-খেলায়,
শৌর্যের খেলা ভীরু মাধুরীর আসঙ্গে॥
আকাশ হতে আকাশ-পথে হাজার স্রোতে
আকাশ হতে আকাশ-পথে হাজার স্রোতে
ঝরছে জগৎ ঝরনাধারার মতো ॥
আমার শরীর মনের অধীর ধারা সাথে সাথে বইছে অবিরত।
দুই প্রবাহের ঘাতে ঘাতে উঠতেছে গান দিনে রাতে,
সেই গানে গানে আমার প্রাণে ঢেউ লেগেছে কত।
আমার হৃদয়তটে চূর্ণ সে গান ছড়ায় শত শত।
ওই আকাশ-ডোবা ধারার দোলায় দুলি অবিরত॥
এই নৃত্য-পাগল ব্যাকুলতা বিশ্বপরানে
নিত্য আমায় জাগিয়ে রাখে, শান্তি না মানে।
চিরদিনের কান্নাহাসি উঠছে ভেসে রাশি রাশি–
এ-সব দেখতেছে কোন্ নিদ্রাহারা নয়ন অবনত।
ওগো, সেই নয়নে নয়ন আমার হোক-না নিমেষহত–
ওই আকাশ-ভরা দেখার সাথে দেখব অবিরত॥
আকাশ, তোমায় কোন্ রূপে মন চিনতে পারে
আকাশ, তোমায় কোন্ রূপে মন চিনতে পারে
তাই ভাবি যে বারে বারে॥
গহন রাতের চন্দ্র তোমার মোহন ফাঁদে
স্বপন দিয়ে মনকে বাঁধে,
প্রভাতসূর্য শুভ্র জ্যোতির তরবারে
ছিন্ন করি ফেলে তারে॥
বসন্তবায় পরান ভুলায় চুপে চুপে,
বৈশাখী ঝড় গর্জি উঠে রূদ্ররূপে।
শ্রাবণমেঘের নিবিড় সজল কাজল ছায়া
দিগ্দিগন্তে ঘনায় মায়া–
আশ্বিনে এই অমল আলোর কিরণধারে
যায় নিয়ে কোন্ মুক্তিপারে॥
আকাশে তোর তেমনি আছে ছুটি
আকাশে তোর তেমনি আছে ছুটি,
অলস যেন না রয় ডানা দুটি॥
ওরে পাখি, ঘন বনের তলে
বাসা তোরে ভুলিয়ে রাখে ছলে,
রাত্রি তোরে মিথ্যে করে বলে–
শিথিল কভু হবে না তার মুঠি॥
জানিস নে কি কিসের আশা চেয়ে
ঘুমের ঘোরে উঠিস গেয়ে গেয়ে।
জানিস নে কি ভোরের আঁধার-মাঝে
আলোর আশা গভীর সুরে বাজে,
আলোর আশা গোপন রহে না যে–
রুদ্ধ কুঁড়ির বাঁধন ফেলে টুটি॥
আজ তারায় তারায় দীপ্ত শিখার অগ্নি জ্বলে
আজ তারায় তারায় দীপ্ত শিখার অগ্নি জ্বলে
নিদ্রাবিহীন গগনতলে॥
ওই আলোক-মাতাল স্বর্গসভার মহাঙ্গন
হোথায় ছিল কোন্ যুগে মোর নিমন্ত্রণ–
আমার লাগল না মন লাগল না,
তাই কালের সাগর পাড়ি দিয়ে এলেম চ’লে
নিদ্রাবিহীন গগনতলে॥
হেথা মন্দমধুর কানাকানি জলে স্থলে
শ্যামল মাটির ধরাতলে।
হেথা ঘাসে ঘাসে রঙিন ফুলের আলিম্পন,
বনের পথে আঁধার-আলোয় আলিঙ্গন–
আমার লাগল রে মন লাগল রে,
তাই এইখানেতেই দিন কাটে এই খেলার ছলে
শ্যামল মাটির ধরাতলে॥
আধেক ঘুমে নয়ন চুমে
আধেক ঘুমে নয়ন চুমে স্বপন দিয়ে যায়।
শ্রান্ত ভালে যূথীর মালে পরশে মৃদু বায়॥
বনের ছায়া মনের সাথি, বাসনা নাহি কিছু–
পথের ধারে আসন পাতি, না চাহি ফিরে পিছু–
বেণুর পাতা মিশায় গাথা নীরব ভাবনায়॥
মেঘের খেলা গগনতটে অলস লিপি-লিখা,
সুদূর কোন্ স্ময়ণপটে জাগিল মরীচিকা।
চৈত্রদিনে তপ্ত বেলা তৃণ-আঁচল পেতে
শূন্যতলে গন্ধ-ভেলা ভাসায় বাতাসেতে–
কপোত ডাকে মধুকশাখে বিজন বেদনায়॥
আনন্দেরই সাগর হতে এসেছে আজ বান
আনন্দেরই সাগর হতে এসেছে আজ বান।
দাঁড় ধ’রে আজ বোস্ রে সবাই, টান রে সবাই টান॥
বোঝা যত বোঝাই করি করব রে পার দুখের তরী,
ঢেউয়ের ‘পরে ধরব পাড়ি– যায় যদি যাক প্রাণ॥
কে ডাকে রে পিছন হতে, কে করে রে মানা,
ভয়ের কথা কে বলে আজ– ভয় আছে সব জানা।
কোন্ শাপে কোন্ গ্রহের দোষে সুখের ডাঙায় থাকব বসে।
পালের রশি ধরব কষি, চলব গেয়ে গান॥
আপন-মনে গোপন কোণে
আপন-মনে গোপন কোণে লেখাজোখার কারখানাতে
দুয়ার রুধে বচন কুঁদে খেলনা আমার হয় বানাতে॥
এই জগতের সকাল সাঁজে ছুটি আমার সকল কাজে,
মিলে মিলে মিলিয়ে কথা রঙে রঙে হয় মানাতে॥
কে গো আছে ভুবন-মাঝে নিত্যশিশু আনন্দেতে,
ডাকে আমায় বিশ্বখেলায় খেলাঘরের জোগান দিতে।
বনের হাওয়ায় সকাল-বেলা ভাসায় সে যে গানের ভেলা,
সেই তো কাঁপায় সুরের কাঁপন মৌমাছিদের নীল ডানাতে॥
আমরা চাষ করি আনন্দে
আমরা চাষ করি আনন্দে।
মাঠে মাঠে বেলা কাটে সকাল হতে সন্ধে॥
রৌদ্র ওঠে, বৃষ্টি পড়ে, বাঁশের বনে পাতা নড়ে,
বাতাস ওঠে ভরে ভরে চষা মাটির গন্ধে॥
সবুজ প্রাণের গানের লেখা রেখায় রেখায় দেয় রে দেখা,
মাতে রে কোন্ তরুণ কবি নৃত্যদোদুল ছন্দে।
ধানের শিষে পুলক ছোটে– সকল ধরা হেসে ওঠে
অঘ্রানেরই সোনার রোদে, পূর্ণিমারই চন্দ্রে॥
আমরা না-গান-গাওয়ার দল রে
আমরা না-গান-গাওয়ার দল রে, আমরা না-গলা-সাধার।
মোদের ভৈঁরোরাগে প্রভাতরবি রাগে মুখ-আঁধার॥
আমাদের এই অমিল-কণ্ঠ-সমবায়ের চোটে
পাড়ার কুকুর সমস্বরে, ও ভাই, ভয়ে ফুক্রে ওঠে–
আমরা কেবল ভয়ে মরি ধূর্জটিদাদার॥
মেঘমল্লার ধরি যদি ঘটে অনাবৃষ্টি,
ছাতিওয়ালার দোকান জুড়ে লাগে শনির দৃষ্টি।
আধখানা সুর যেমনি লাগাই বসন্তবাহারে
মলয়বায়ুর ধাত ফিরে যায়, তৎক্ষণাৎ আহা রে
সেই হাওয়াতে বিচ্ছেদতাপ পালায় শ্রীরাধায়॥
অমাবস্যার রাত্রে যেমনি বেহাগ গাইতে বসা
কোকিলগুলোর লাগে দশম-দশা।
শুক্লকোজাগরী নিশায় জয়জয়ন্তী ধরি,
অমনি মরি মরি
রাহু-লাগার বেদন লাগে পূর্ণিমা-চাঁদার॥