- বইয়ের নামঃ লিপিকা
- লেখকের নামঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- প্রকাশনাঃ বিশ্বসাহিত্য ভবন
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
অস্পষ্ট
জানলার ফাঁকে ফাঁকে দেখা যায় সামনের বাড়ির জীবনযাত্রা। রেখা আর ছেদ, দেখা আর না-দেখা দিয়ে সেই ছবি আঁকা।
একদিন পড়ার বই পড়ে রইল, বনমালীর চোখ গেল সেই দিকে।
সেদিন দেখে, সে বাড়ির ঘরকন্নার পুরোনো পটের উপর দুজন নতুন লোকের চেহারা। একজন বিধবা প্রবীণা, আর-একটি মেয়ের বয়স ষোলো হবে কি সতেরো।
সেই প্রবীণা জানলার ধারে বসে মেয়েটির চুল বেঁধে দিচ্ছে, আর মেয়ের চোখ বেয়ে জল পড়ছে।
আর-একদিন দেখা গেল, চুল বাঁধবার লোকটি নেই। মেয়েটি দিনান্তের শেষ আলোতে ঝুঁকে প’ড়ে বোধ হল যেন একটি পুরোনো ফোটোগ্রাফের ফ্রেম আঁচল দিয়ে মাজছে।
তার পর দেখা যায়, জানলার ছেদগুলির মধ্যে দিয়ে ওর প্রতি দিনের কাজের ধারা—কোলের কাছে ধামা নিয়ে ডাল বাছা, জাঁতি হাতে সুপুরি কাটা, স্নানের পরে বাঁ হাত দিয়ে নেড়ে নেড়ে ভিজে চুল শুকোনো, বারান্দার রেলিঙের উপরে বালাপোশ রোদ্দুরে মেলে দেওয়া।
দুপুরবেলায় পুরুষেরা আপিসে; মেয়েরা কেউ বা ঘুমোয়, কেউ বা তাস খেলে; ছাতে পায়রার খোপে পায়রাদের বক্বক্ম মিইয়ে আসে।
সেই সময়ে মেয়েটি ছাতের চিলেকোঠায় পা মেলে বই পড়ে; কোনোদিন বা বইয়ের উপর কাগজ রেখে চিঠি লেখে, আবাঁধা চুল কপালের উপরে থমকে থাকে, আর আঙুল যেন চলতে চলতে চিঠির কানে কানে কথা কয়।
একদিন বাধা পড়ল। সেদিন সে খানিকটা লিখছে চিঠি, খানিকটা খেলছে কলম নিয়ে, আর আলসের উপরে একটা কাক আধখাওয়া আমের আঁঠি ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে।
এমন সময়ে যেন পঞ্চমীর অন্যমনা চাঁদের কণার পিছনে পা টিপে টিপে একটা মোটা মেঘ এসে দাঁড়ালো। মেয়েটি আধাবয়সি। তার মোটা হাতে মোটা কাঁকন। তার সামনের চুল ফাঁক, সেখানে সিঁথির জায়গায় মোটা সিঁদুর আঁকা।
বালিকার কোল থেকে তার না-শেষ-করা চিঠিখানা সে আচমকা ছিনিয়ে নিলে। বাজপাখি হঠাৎ পায়রার পিঠের উপর পড়ল।
ছাতে আর মেয়েটিকে দেখা যায় না। কখনো বা গভীর রাতে, কখনো বা সকালে বিকালে, ঐ বাড়ি থেকে এমন-সব আভাস আসে যার থেকে বোঝা যায়, সংসারটার তলা ফাটিয়ে দিয়ে একটা ভূমিকম্প বেরিয়ে আসবার জন্যে মাথা ঠুকছে।
এ দিকে জানলার ফাঁকে ফাঁকে চলছে ডাল বাছা আর পান সাজা; ক্ষণে ক্ষণে দুধের কড়া নিয়ে মেয়েটি চলেছে উঠোনে কলতলায়।
এমনি কিছুদিন যায়। সেদিন কার্তিক মাসের সন্ধ্যাবেলা; ছাদের উপর আকাশপ্রদীপ জ্বলেছে, আস্তাবলের ধোঁয়া অজগর সাপের মতো পাক দিয়ে আকাশের নিশ্বাস বন্ধ করে দিলে।
বনমালী বাইরে থেকে ফিরে এসে যেমনি ঘরের জানলা খুলল অমনি তার চোখে পড়ল, সেই মেয়েটি ছাদের উপর হাত জোড় করে স্থির দাঁড়িয়ে। তখন গলির শেষ প্রান্তে মল্লিকদের ঠাকুরঘরে আরতির কাঁসর ঘণ্টা বাজছে। অনেক ক্ষণ পরে ভূমিষ্ঠ হয়ে মেঝেতে মাথা ঠুকে ঠুকে বারবার সে প্রণাম করলে; তার পরে চলে গেল।
সেদিন বনমালী নীচে গিয়েই চিঠি লিখলে। লিখেই নিজে গিয়ে তখনি ডাকবাক্সে ফেলে দিয়ে এল।
রাত্রে বিছানায় শুয়ে শুয়ে একমনে কামনা করতে লাগল, সে চিঠি যেন না পৌঁছয়। সকালবেলায় উঠে সেই বাড়ির দিকে যেন মুখ তুলে চাইতে পারলে না।
সেই দিনই বনমালী মধুপুরে চলে গেল; কোথায় গেল কাউকে বলে গেল না।
কলেজ খোলবার সময় সময় ফিরে এল। তখন সন্ধ্যাবেলা। সামনের বাড়ির আগাগোড়া সব বন্ধ, সব অন্ধকার। ওরা সব গেল কোথায়।
বনমালী বলে উঠল, ‘যাক, ভালোই হয়েছে।’
ঘরে ঢুকে দেখে ডেস্কের উপরে একরাশ চিঠি। সব-নীচের চিঠির শিরোনাম মেয়েলি হাতের ছাঁদে লেখা, অজানা হাতের অক্ষরে, তাতে পাড়ার পোস্ট-আপিসের ছাপ।
চিঠিখানি হাতে করে সে বসে রইল। লেফাফা খুললে না। কেবল আলোর সামনে তুলে ধরে দেখলে। জানালার ভিতর দিয়ে জীবনযাত্রার যেমন অস্পষ্ট ছবি, আবরণের ভিতর দিয়ে তেমনি অস্পষ্ট অক্ষর।
একবার খুলতে গেল, তার পরে বাক্সের মধ্যে চিঠিটা রেখে চাবি বন্ধ করে দিলে; শপথ করে বললে, ‘এ চিঠি কোনোদিন খুলব না।’
শ্রাবণ ১৩২৬
আগমনী
আয়োজন চলেইছে। তার মাঝে একটুও ফাঁক পাওয়া যায় না যে ভেবে দেখি, কিসের আয়োজন।
তবুও কাজের ভিড়ের মধ্যে মনকে এক-একবার ঠেলা দিয়ে জিজ্ঞাসা করি, ‘কেউ আসবে বুঝি?’
মন বলে, ‘রোসো। আমাকে জায়গা দখল করতে হবে, জিনিসপত্র জোগাতে হবে, ঘরবাড়ি গড়তে হবে, এখন আমাকে বাজে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা কোরো না।’
চুপচাপ করে আবার খাটতে বসি। ভাবি, জায়গা-দখল সারা হবে, জিনিসপত্র-সংগ্রহ শেষ হবে, ঘরবাড়ি-গড়া বাকি থাকবে না, তখন শেষ জবাব মিলবে।
জায়গা বেড়ে চলছে, জিনিসপত্র কম হল না, ইমারতের সাতটা মহল সারা হল। আমি বললেম, ‘এইবার আমার কথার একটা জবাব দাও।’
মন বলে, ‘আরে রোসো, আমার সময় নেই।’
আমি বললেম, ‘কেন, আরও জায়গা চাই? আরও ঘর? আরও সরঞ্জাম?’
মন বললে, ‘চাই বই কি।’
আমি বললেম,‘এখনও যথেষ্ট হয় নি?’
মন বললে, ‘এতটুকুতে ধরবে কেন।’
আমি জিজ্ঞাসা করলেম, ‘কী ধরবে। কাকে ধরবে।’
মন বললে, ‘সেসব কথা পরে হবে।’
তবু আমি প্রশ্ন করলেম, ‘সে বুঝি মস্ত বড়ো?’
মন উত্তর করলে, ‘বড়ো বই কি।’
এত বড়ো ঘরেও তাকে কুলোবে না, এত মস্ত জায়গায়! আবার উঠে পড়ে লাগলেম। দিনে আহার নেই, রাত্রে নিদ্রা নেই। যে দেখলে সেই বাহবা দিলে; বললে, ‘কাজের লোক বটে।’