- বইয়ের নামঃ বাসর
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
এখানে কিছু রহস্য আছে
এখানে কিছু রহস্য আছে।
অতীন্দ্রিয় রহস্য। মাঝেমাঝে কড়া ফুলের গন্ধ পাওয়া যায়। এমন কড়া যে, গা ঝিমঝিম করে-মাথা ধরে যায়।
জায়গাটা হচ্ছে রিং রোডের মাঝামাঝি শ্যামলী থেকে আদাবরের দিকে যাবার ইট-বিছানো রাস্তা। আশেপাশে কোনো ফুলের গাছ নেই যে, ফুলের গন্ধ আসবে। তাছাড়া ফুলের গন্ধে গা ঝিমঝিম করে না। নিশ্চয়ই অন্য কোনো ব্যাপার। কোনো জটিল রহস্য।
আহসান আজ আবার গন্ধটা পাচ্ছে। গতকাল ছিল না, তার আগের দিনও ছিল না। ব্যাপারটা কী? রাত প্রায় এগারটা। আহসান চিন্তিত মুখে সিগারেট ধরাল। এরকম নিৰ্জন রাস্তায় এত রাতে সিগারেট ধরিয়ে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। আশেপাশে খুব ছিনতাই হচ্ছে। দাড়ি-গোঁফ এখনো গজায় নি এমন সব ছেলেপুলেরা পেনসিল-কাটা ছুরি দেখিয়ে মানিব্যাগ নিয়ে যাচ্ছে। এরকম সময়ে গন্ধ-রহস্য ভেদ করার জন্যে মাঝরাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকার কোন অর্থ হয় না।
আশ্চর্য, গন্ধটা হঠাৎ মিলিয়ে গেল। এই রহস্যের কোন মানে হয়? এটা নিয়ে কারো সঙ্গে আলাপ করলে হয়। কিন্তু এই ব্যাপারটা আদাবরের রাস্তায় পা না-দেয়া পর্যন্ত মনে আসে না। যখন মনে আসে তখন আশেপাশে কেউ থাকে না যার সঙ্গে আলোচনা করা যায়।
আদাবরের দিক থেকে পাঁচ-টনি ট্রাক আসছে। রাস্তায় লোকজন নেই বলেই ট্রাক আসছে টিমে-তেলা গতিতে। লোজন থাকলে ঝড়ের গতিতে চলে আসত। আহসান একপাশে সরে দাঁড়াল। হেড-লাইটের আলোয় তার চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। তাকানো যাচ্ছে না, আবার চোখ ফিরিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না। কড়া আলোর একধরনের সম্মােহনী শক্তি আছে। শুধু পতঙ্গ না—এই আলো মানুষকে আকৃষ্ট করে।
ট্রাকটা আহসানের ঠিক গায়ের ওপর এসে আচমকা ব্ৰেক কষল। ড্রাইভার দরজা খুলে অর্ধেকটা শরীর বের করে তাকে হাত ইশারা করে ডাকছে। ড্রাইভার বা দারোয়ান শ্ৰেণীর কেউ হাত ইশারা করে ডাকলে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। তবে এই ড্ৰাইভার আহসানের চেনা। তার বাড়িওয়াল করিম সাহেবের ড্রাইভার। বাড়িওয়ালার বাড়ির একতলায় থাকে। নাম নাজিম, নিজাম কিংবা এই ধরনের কিছু। আহসানের সঙ্গে দেখা হলে লাল চোখে তাকায় এবং পান খাওয়া হলুদ দাঁত বের করে হাসে। আবার মাঝে-মাঝে না-চেনার ভঙ্গি করে।
প্ৰবেসার সাব, খবর হুনছেন?
না। কি খবর?
করিম সাবের কথা কিছু হুনছেন?
না। যায়-যায় অবস্থা। অক্সিজেন চলছে….
কী হয়েছে?
এক্সিডেন—টেম্পোর লগে ধাক্কা–মাথা গুড়া। খুবই আফসোসের কথা, কি কন প্রবেসার সাব?
আহসান কিছু বলল না। ফুলের গন্ধটা আবার পাওয়া যাচ্ছে। পেট্রল এবং ধোঁয়ার গন্ধ ছাপিয়ে মিষ্টি একটা গন্ধ। এর মানেটা কী? রহস্যটা কোথায়?
আরিচা থনে টিরিপ আইন্যা খবর হুনলাম। মিজাজ ঠিক নাই আমার বুঝছেন প্রবেসার সাব। দেখবার যাইতাছি।
ড্রাইভার দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। গিয়ার বদলাতে-বদলাতে বলল, এর নাম হালার দুনিয়া। আজিব জাগা। প্ৰবেসার সাব, যাই।
এবার ট্রাক ছুটছে ঝড়ের মতো। আহসানের মনে হল একটা ভুল হয়ে গেছে—তার উচিত ছিল ড্রাইভারের সঙ্গে যাওয়া। ব্যাপারটা মনে হয় নি। ফুলের গন্ধ সব এলোমেললা করে দিয়েছে।
করিম সাহেব লোকটিকে সে পছন্দ করে। বেঁটেখাটো মানুষ। মুখভর্তি পান। হাসিখুশি। পাশ দিয়ে গেলে জরদার চমৎকার গন্ধ পাওয়া যায়। ভদ্রলোক এমন ভঙ্গিতে পান খান যে, মনে হয় স্বগীয় কোনো খাদ্য চিবুচ্ছেন। তাঁকে দেখলেই পান খেতে ইচ্ছা করে।
বাড়িওয়ালারা প্রায়ই বেশ নামাজি হয় ইনিও তাই। তাঁর গায়ে সবসময় পরিষ্কার ঝকঝকে একটা পাঞ্জাবি থাকে। মাথায় তার চেয়েও পরিষ্কার একটা টুপি। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। বেশ নাদুসনুদুস। দেখলেই মনে হয়, খুব শিগগিরই এর হার্ট অ্যাটাক বা মাইল্ড স্ট্রোক জাতীয় কিছু হবে। কিন্তু হয় না। তাঁর তিন জন ভাড়াটে আছে। যাদের সবার সঙ্গেই তাঁর সুসম্পর্ক। দুজন ভাড়াটে তাঁকে চাচা ডাকে। আহসান তাঁকে কিছুই ডাকে না; তবে তিনি আকার-ইঙ্গিতে প্রায়ই বুঝিয়ে দেন যে, আহসানকে তিনি নিজের ছেলের মতো দেখেন।
ভদ্রলোকের পাঁচ মেয়ে, কোনো ছেলে নেই। বড় তিনটি মেয়ে স্কুল-কলেজে কোথাও যায় না। সম্ভবত বিয়ের জন্যে অপেক্ষা করে। ছোট দুটি স্কুলে যায়। আহসানের সঙ্গে দেখা হলে এই দুই স্কুল-যাত্রী মৌলানাদের মতো টেনে-টেনে বলে, আসোলামু আলায়কুম। আহসান তার উত্তরে সবসময় বলে, কী খবর ভালো?
এই প্রশ্নের উত্তর এরা দেয় না। গম্ভীর হয়ে থাকে। হাসেও না। মনে হয় খানিকটা বিরক্ত হয়।
করিম সাহেব মাঝেমধ্যে তাকে খেতে ডাকেন। অন্য ভাড়াটেদের ডাকেন না। সে একা-একা থাকে, এই কারণেই হয়ত; কিংবা কে জানে হয়ত তাঁর কোনো পরিকল্পনা আছে। যাঁর বড়-বড় তিনটি মেয়ে বিয়ের জন্যে অপেক্ষা করছে তাঁর পরিকল্পনা থাকা অন্যায় নয়। অবশ্যি তিনি এখন পর্যন্ত ইশারা বা ইঙ্গিতে এ বিষয়ে কিছু বলেন নি। মেয়েদের প্রসঙ্গে তিনি যা বলেন তার সারমর্ম হচ্ছে—মেয়েগুলো মহা অপদার্থ। সংসারের কিছু জানে না কিছু বোঝে না। দিনরাত ঝগড়া করে আর টাকা জমায়।
আহসান অবাক হয়ে বলেছিল, টাকা জমায় মানে?
জমায় মানে জমায়-সঞ্চয়।
পায় কোথায় টাকা? আপনি দেন?
পাগল, আমি দিব কেন? ওরা চুরি করে। মার কাছ থেকে চুরি করে, মাঝে-মাঝে আমার পকেটে হাত দেয়; মহা হারামী। আগে চড়-থাপ্পড় দিতাম, এখন বড় হয়ে গেছে, চড়-থাপ্পড় দিতে পারি না। যখন মেজাজ ঠিক থাকে না দিই। তখন তাদের মা কান্দে। এরা হইল কান্দন পার্টি। মা কান্দে, মেয়ে কান্দে। একবার কী হইল শুনেন-প্রাইভেট মাস্টার আসছে। বড় মেয়েটাকে পড়াইছে, হঠাৎ কারেন্ট নাই। মাস্টার হারামজাদা সুযোগ বুইঝা গায়ে হাত দিছে। বুঝেন অবস্থা। মেয়ে কোন শব্দ করে না—ফিচ-ফিচ কইরা কান্দে। বুঝেন অবস্থা। মা যেমুন বোকা—আমার মেয়েগুলোও হইছে বোকা। বাজারের সেরা বোকা।