- বইয়ের নামঃ পুতুল
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ প্রতীক প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
পুতুলের ঘর থেকে
উৎসর্গ
নীলু, কল্যাণীয়াসু
কত না দিন রাতি
তুমি ছিলে আমার খেলার সাথী’
.
০১.
পুতুলের ঘর থেকে তাদের বাগানটা দেখা যায়। এত সুন্দর লাগে তার! শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। তাদের বাগান অন্যদের বাগানের মতো নয়। তিনটা বিশাল বড়ো বড়ো গাছ, একটা রেনট্রি গাছ। এত বড়ো যে মনে হয় এই গাছের পাতাগুলো আকাশে লেগে গেছে। আর দুটি হচ্ছে কদম ফুলের গাছ। কদম ফুলের গাছ দুটি পাশাপাশি–যেন দুই জমজ বোন, এক জন অন্য জনের গায়ে হেলান দিয়ে আছে। বর্ষাকালে গাছ দুটিতে কী অদ্ভুত ফুল ফোটে। সোনার বলের মতো ফুল।
পুতুলের মা জেসমিন কদম ফুলের গাছ দুটি একেবারেই সহ্য করতে পারেন না। কারণ হচ্ছে শুয়োপোকা। কদম গাছে খুব শুয়োপোকা হয়। আর শুয়োপোকা দেখলেই জেসমিনের বমি পেয়ে যায়। তিনি প্রতি শীতকালে একবার করে বলেন–গাছগুলো কাটিয়ে ফেলা দরকার। শেষ পর্যন্ত কেন জানি কাটা হয় না। দেখতে দেখতে বর্ষা এসে যায়। অদ্ভুত কদম ফুলগুলো ফোটে। কী যে ভাল লাগে পুতুলের!
এখন শীতকাল। ক’দিন আগে ঠিক করা হয়েছে বড়ো বড়ো গাছগুলো সব কেটে ফেলা হবে। জেসমিন বজলু মিয়া বলে একটি লোককে ঠিক করেছেন। লোকটির মুখে বসন্তের দাগ। তার একটা চোখও নষ্ট। ভালো চোখটি দিয়ে সে সবার দিকে বিশ্রীভাবে তাকায়। বজলু মিয়া গতকাল এসে বড়ো বড়ো গাছগুলো সব দেখে গেছে। দড়ি দিয়ে কি সব মাপ– টাপও নিয়েছে। বলে গেছে সোমবারে লোজন নিয়ে আসবে।
পুতুলের এই জন্যেই খুব মন খারাপ। গাছগুলোর দিকে তাকালেই। তার কান্না পেয়ে যায়। বাগানে এলেই সে এখন গাছগুলোর গায়ে হাত বুলিয়ে ফিসফিস করে কি সব কথা বলে। হয়তো-বা সান্ত্বনার কোনো কথা। আজও তাই করছিল। গাছের গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে সে লক্ষ করল তার বাবা বাগানে হাঁটছেন। তাঁর হাতে একটা ভাঁজ-করা খবরের কাগজ। তিনি অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে হাঁটছেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে খুব রেগে আছেন। খুব রেগে গেলে তিনি এ রকম গম্ভীর হয়ে যান। বাগানে কিংবা ছাদে মাথা নিচু করে হাঁটেন। পুতুলের মনে হল আজ বোধ হয় বাবা-মা’র মধ্যে ঝগড়া হয়েছে। এই একটা খারাপ ব্যাপার। দু’দিন পর পর তাঁরা ঝগড়া করেন। ঝগড়া করবে ঘোটরা। আড়ি দেবে–ভাব নেবে। বড়োরা এ রকম করবে কেন?
পুতুল ছোট ঘোট পা ফেলে রেনট্রি গাছটার দিকে যাচ্ছে। তার চোখ বাবার দিকে। বাবা কতটা রেগে আছেন সে বুঝতে চেষ্টা করছে। পুতুলের বয়স এগারো। এই বয়সের ছেলেরা চারদিকে কি হচ্ছে না-হচ্ছে খুব বুঝতে চেষ্টা করে।
রহমান সাহেব পুতুলকে রেনট্টি গাছটার দিকে যেতে দেখলেন। কিছু বললেন না। তিনি জানেন, এই গাছের নিচে পুতুল প্রায়ই এসে বসে। এটা সম্ভবত পুতুলের কোনো গোপন জায়গা। সব শিশুদের কিছু গোপন জায়গা থাকে। তাঁর নিজেরও ছিল। পুতুলকে দেখে মাঝে মাঝে তাঁর নিজের শৈশবের কথা মনে হয়। তবে তিনি পুতুলের মতো নিঃসঙ্গ ছিলেন না। অনেক ভাইবোনের মধ্যে বড় হয়েছেন। তাঁদের বাড়িটা ছিল হৈচৈ হুল্লোড়ের বাড়ি। নিজের ভাইবোন ছাড়াও চাচাতো ভাইবোন, ফুপাতো ভাইবোন, পাড়ার ছেলেপেলে। সারাদিন চিৎকার চেঁচামেচি হৈচৈ।
রহমান সাহেব রোদে পিঠ দিয়ে বসলেন। বসতে হল ঘাসে। এমন ভাবে বসেছেন যেন পুতুল কী করছে দেখা যায়। তিনি সারাদিন ব্যস্ত থাকেন, পুতুল কী করে না-করে খবর রাখতে পারেন না। ছেলেটা খুবই একা। তাকে আরো কিছু সময় দেওয়া দরকার। তা তিনি দিতে পারছেন না। তিনি মৃদু গলায় ডাকলেন, পুতুল।
জ্বী বাবা?
কী করছ তুমি?
কিছু করছি না। কাছে আস।
পুতুল ভয়ে ভয়ে এগিয়ে আসছে। তিনি লক্ষ করলেন, পুতুলের খালি পা। অথচ তাকে অনেক বার বলা হয়েছে খালি পায়ে বাগানে না আসতে। গায়েও পাতলা একটা শার্ট ছাড়া কিছু নেই। শীতের সকালবেলা পাতলা একটা জামা পরে কেউ থাকে? রহমান সাহেব খুব বিরক্ত হলেন। বিরক্তি প্রকাশ করলেন না। ছেলেটা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। এ রকম হাসিমুখের একটি ছেলেকে ধমক দিতে মায়া লাগে।
তুমি প্রায়ই ঐ রেনট্রি গাছটার নিচে বসে থাক। কী কর ওখানে?
কিছু করি না। বসে থাকি।
কিছু নিশ্চয়ই কর। শুধু শুধু কি কেউ বসে থাকে?
পুতুল লাজুক ভঙ্গিতে হাসল। তার হাসি বলে দিচ্ছে সে শুধু শুধু বসে থাকে না। রহমান সাহেব বললেন, বসে বসে ভাব, তাই না?
হ্যাঁ ভাবি।
কী নিয়ে ভাব?
পুতুল উত্তর না দিয়ে আবার লাজুক ভঙ্গিতে হাসল। রহমান সাহেবের ইচ্ছে করল ছেলেটাকে পাশে বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। মাথা ভর্তি রেশমের মতো চুল। দেখলেই হাত বোলাতে ইচ্ছে করে।
আজ তোমার শরীর কেমন?
ভালো।
কী রকম ভালো সেটা বল–খুব ভালো, না অল্প ভালো–নাকি মন্দের ভালো।
খুব ভালো।
আচ্ছা ঠিক আছে। যাও–যা করছিলে কর।
পুতুল গেল না। দাঁড়িয়ে রইল। মনে হচ্ছে তার কিছু বলার আছে। কিছু বলতে চাচ্ছে অথচ বলতে পারছে না। রহমান সাহেবের খানিকটা মন খারাপ হল। এত বাচ্চা একটি ছেলে, সে কেন মনের কথাগুলো সহজভাবে বাবা-মা’কে বলতে পারবে না। তিনি নরম গলায় বললেন, পুতুল তুমি কি কিছু বলতে চাও?