- বইয়ের নামঃ খাপছাড়া
- লেখকের নামঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- প্রকাশনাঃ যুক্ত প্রকাশনা
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অল্পেতে খুশি হবে
অল্পেতে খুশি হবে
দামোদর শেঠ কি।
মুড়কির মোয়া চাই,
চাই ভাজা ভেটকি।
আনবে কট্কি জুতো,
মট্কিতে ঘি এনো,
জলপাইগুঁড়ি থেকে
এনো কই জিয়োনো–
চাঁদনিতে পাওয়া যাবে
বোয়ালের পেট কি।
চিনেবাজারের থেকে
এনো তো করমচা,
কাঁকড়ার ডিম চাই,
চাই যে গরম চা,
নাহয় খরচা হবে
মাথা হবে হেঁট কি।
মনে রেখো বড়ো মাপে
করা চাই আয়োজন,
কলেবর খাটো নয়–
তিন মোন প্রায় ওজন।
খোঁজ নিয়ো ঝড়িয়াতে
জিলিপির রেট কী।
আইডিয়াল নিয়ে থাকে
আইডিয়াল নিয়ে থাকে, নাহি চড়ে হাঁড়ি।
প্রাক্টিক্যাল লোকে বলে, এ যে বাড়াবাড়ি।
শিবনেত্র হল বুঝি, এইবার মোলো–
অক্সিজেন নাকে দিয়ে চাঙ্গা ক’রে তোলো।
আদর ক’রে মেয়ের নাম
আদর ক’রে মেয়ের নাম
রেখেছে ক্যালিফর্নিয়া,
গরম হল বিয়ের হাট
ঐ মেয়েরই দর নিয়া।
মহেশদাদা খুঁজিয়া গ্রামে গ্রামে
পেয়েছে ছেলে ম্যাসাচুসেট্স্ নামে,
শাশুড়ি বুড়ি ভীষণ খুশি
নামজাদা সে বর নিয়া–
ভাটের দল চেঁচিয়ে মরে
নামের গুণ বর্ণিয়া।
আধখানা বেল
আধখানা বেল
খেয়ে কানু বলে,–
“কোথা গেল বেল
একখানা।’
আধা গেলে শুধু
আধা বাকি থাকে,
যত করি আমি
ব্যাখ্যানা,
সে বলে, “তাহলে মহা ঠকিলাম,
আমি তো দিয়েছি ষোল আনা দাম।’–
হাতে হাতে সেটা করিল প্রমাণ
ঝাড়া দিয়ে তার
ব্যাগখানা।
আধা রাতে গলা ছেড়ে
আধা রাতে গলা ছেড়ে
মেতেছিনু কাব্যে,
ভাবিনি পাড়ার লোকে
মনেতে কী ভাববে।
ঠেলা দেয় জানলায়,
শেষে দ্বার-ভাঙাভাঙি,
ঘরে ঢুকে দলে দলে
মহা চোখ-রাঙারাঙি–
শ্রাব্য আমার ডোবে
ওদেরই অশ্রাব্যে।
আমি শুধু করেছিনু
সামান্য ভনিতাই,
সামলাতে পারল না
অরসিক জনে তাই–
কে জানিত অধৈর্য
মোর পিঠে নাববে!
আপিস থেকে ঘরে এসে
আপিস থেকে ঘরে এসে
মিলত গরম আহার্য,
আজকে থেকে রইবে না আর
তাহার জো।
বিধবা সেই পিসি ম’রে
গিয়েছে ঘর খালি করে,
বদ্দি স্বয়ং করেছে তার
সাহায্য।
আমার পাচকবর গদাধর মিশ্র
আমার পাচকবর গদাধর মিশ্র,
তারি ঘরে দেখি মোর কুন্তলবৃষ্য।
কহিনু তাহারে ডেকে,–
“এ শিশিটা এনেছে কে,
শোভন করিতে চাও হেঁশেলের দৃশ্য?’
সে কহিল, “বরিষার
এই ঋতু; সরিষার
কহে, “কাঠমুণ্ডার
নেপালের গুণ্ডার
এই তেলে কেটে যায় জঠরের গ্রীষ্ম।
লোকমুখে শুনেছি তো, রাজা-গোলকুণ্ডার
এই সাত্ত্বিক তেলে পূজার হবিষ্য।
আমি আর তাঁরা সবে চরকের শিষ্য।’
আয়না দেখেই চমকে বলে
আয়না দেখেই চমকে বলে,
“মুখ যে দেখি ফ্যাকাশে,
বেশিদিন আর বাঁচব না তো–‘
ভাবছে বসে একা সে।
ডাক্তারেরা লুটল কড়ি,
খাওয়ায় জোলাপ, খাওয়ায় বড়ি,
অবশেষে বাঁচল না সেই
বয়স যখন একাশি।
ইঁটের গাদার নিচে
ইঁটের গাদার নিচে
ফটকের ঘড়িটা।
ভাঙা দেয়ালের গায়ে
হেলে-পড়া কড়িটা।
পাঁচিলটা নেই, আছে
কিছু ইঁট সুরকি।
নেই দই সন্দেশ,
আছে খই মুড়কি।
ফাটা হুঁকো আছে হাতে,
গেছে গড়গড়িটা।
গলায় দেবার মতো
বাকি আছে দড়িটা।
ইতিহাসবিশারদ গণেশ ধুরন্ধর
ইতিহাসবিশারদ গণেশ ধুরন্ধর
ইজারা নিয়েছে একা বম্বাই বন্দর।
নিয়ে সাতজন জেলে
দেখে মাপকাঠি ফেলে–
সাগরমথনে কোথা উঠেছিল চন্দর,
কোথা ডুব দিয়ে আছে ডানাকাটা মন্দর।
ইদিলপুরেতে বাস নরহরি শর্মা
ইদিলপুরেতে বাস নরহরি শর্মা,
হঠাৎ খেয়াল গেল যাবেই সে বর্মা।
দেখবে-শুনবে কে যে তাই নিয়ে ভাবনা,
রাঁধবে বাড়বে, দেবে গোরুটাকে জাবনা–
সহধর্মিণী নেই, খোঁজে সহধর্মা।
গেল তাই খণ্ডালা, গেল তাই অণ্ডালে,
মহা রেগে গাল দেয় রেলগাড়ি-চণ্ডালে,
সাথি খুঁজে সে বেচারা কী গলদ্ঘর্মা–
বিস্তর ভেবে শেষে গেল সে কোডর্মা।
ইস্কুল-এড়ায়নে সেই ছিল বরিষ্ঠ
ইস্কুল-এড়ায়নে
সেই ছিল বরিষ্ঠ,
ফেল-করা ছেলেদের
সবচেয়ে গরিষ্ঠ।
কাজ যদি জুটে যায়
দুদিনে তা ছুটে যায়,
চাকরির বিভাগে সে
অতিশয় নড়িষ্ঠ–
গলদ করিতে কাজে
ভয়ানক দ্রঢ়িষ্ঠ।
ইয়ারিং ছিল তার দু কানেই
ইয়ারিং ছিল তার দু কানেই।
গেল যবে স্যাকরার দোকানেই
মনে প’ল, গয়না তো চাওয়া যায়,
আরেকটা কান কোথা পাওয়া যায়–
সে কথাটা নোটবুকে টোকা নেই!
মাসি বলে, “তোর মত বোকা নেই।’
উজ্জ্বলে ভয় তার
উজ্জ্বলে ভয় তার,
ভয় মিট্মিটেতে,
ঝালে তার যত ভয়
তত ভয় মিঠেতে।
ভয় তার পশ্চিমে,
ভয় তার পূর্বে,
যে দিকে তাকায় ভয়
সাথে সাথে ঘুরবে।
ভয় তার আপনার
বাড়িটার ইঁটেতে,
ভয় তার অকারণে
অপরের ভিটেতে।
ভয় তার বাহিরেতে,
ভয় তার অন্তরে,
ভয় তার ভূত-প্রেতে,
ভয় তার মন্তরে।
দিনের আলোতে ভয়
সামনের দিঠেতে,
রাতের আঁধারে ভয়
আপনারি পিঠেতে।
উৎসর্গ (সহজ কথায় লিখতে আমায় কহ যে)
শ্রীযুক্ত রাজশেখর বসু
সহজ কথায় লিখতে আমায় কহ যে,
সহজ কথা যায় না লেখা সহজে।
লেখার কথা মাথায় যদি জোটে
তখন আমি লিখতে পারি হয়তো।
কঠিন লেখা নয়কো কঠিন মোটে,
যা-তা লেখা তেমন সহজ নয় তো।
যদি দেখ খোলসটা
খসিয়াছে বৃদ্ধের,
যদি দেখ চপলতা
প্রলাপেতে সফলতা
ফলেছে জীবনে সেই ছেলেমিতে-সিদ্ধের,
যদি ধরা পড়ে সে যে নয় ঐকান্তিক
ঘোর বৈদান্তিক,
দেখ গম্ভীরতায় নয় অতলান্তিক,
যদি দেখ কথা তার
কোনো মানে-মোদ্দার
হয়তো ধারে না ধার, মাথা উদ্ভ্রান্তিক,
মনখানা পৌঁছয় খ্যাপামির প্রান্তিক,
তবে তার শিক্ষার
দাও যদি ধিক্কার–
সুধাব, বিধির মুখ চারিটা কী কারণে।
একটাতে দর্শন
করে বাণী বর্ষণ,
একটা ধ্বনিত হয় বেদ-উচ্চারণে।
একটাতে কবিতা
রসে হয় দ্রবিতা,
কাজে লাগে মনটারে উচাটনে মারণে।
নিশ্চিত জেনো তবে,
একটাতে হো হো রবে
পাগলামি বেড়া ভেঙে উঠে উচ্ছ্বাসিয়া।
তাই তারি ধাক্কায়
বাজে কথা পাক খায়,
আওড় পাকাতে থাকে মগজেতে আসিয়া।
চতুর্মুখের চেলা কবিটিরে বলিলে
তোমরা যতই হাস, রবে সেটা দলিলে।
দেখাবে সৃষ্টি নিয়ে খেলে বটে কল্পনা,
অনাসৃষ্টিতে তবু ঝোঁকটাও অল্প না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শান্তিনিকেতন, ৩ ভাদ্র, ১৩৪৩