- বইয়ের নামঃ তোমাকে
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অনন্যা
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী, রোম্যান্টিক গল্পের বই
নীলু আমার চেয়ে এগারো মিনিটের বড়
নীলু বয়সে আমার চেয়ে এগারো মিনিটের বড়। তার জন্মের এগারো মিনিট পর আমার জন্ম হয় এবং দারুণ একটা হৈচৈ শুরু হয়। ডাক্তার শমসের আলি অবাক হয়ে চেঁচিয়ে ওঠেন, আরে যমজ। বাচ্চা দেখি। ঠিক তখন ইলেকট্রসিটি চলে গিয়ে চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। আমরা দুই বোন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে থাকি। ডাক্তার শমসের আলি হারিকেনের জন্যে চোঁচাতে থাকেন। আমার নানিজান ছুটে ঘর থেকে বেরুতে গিয়ে পানির একটা গামলা উল্টে ফেলেন।
আমার জন্মের সময় চারদিক অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল বলে বাবা আমার নাম রাখেন রাত্রি। নীলু জনের পর পর খুব কাদছিল, তাই তার নাম কান্না। এইসব কাব্যিক নাম অবশ্যি টিকল না। একজন হল নীলু। তার সাথে মিলে রেখে আমি হলাম বিলু। তার চার বছর পর আমাদের তিন নম্বর বোনটি হল; মিল দিয়ে নাম রাখলে শুধু মেয়েই হতে থাকবে এই জন্যে তার নাম হল সেতারা। নীলু, বিলু এবং সেতারা।
বাবার রাখা নাম না টিকলেও বাবা কিন্তু হাল ছাড়লেন না। সুযোগ পেলেই চেঁচিয়ে ডাকতেন, কোথায় আমার বড় বেটি কান্না? কোথায় আমার মেজো বেটি রাত্রি? জন্মদিনে বই উপহার দেবার সময় বইয়ের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় গোটা গোটা হরফে লিখতেন, মামণি রাত্রিকে ভালবাসার সহিত দিলাম কিংবা মামণি কান্নাকে পরম আদরের সহিত দেওয়া হইল।
বইয়ের সঙ্গে সব সময় একটা করে তার স্বরচিত কবিতা থাকত। সে কবিতা তিনি তার প্রেস থেকে ছাপিয়ে ফ্রেম করে বঁধিয়ে আনতেন। আট বছরেব জন্মদিনে আমি এবং নীলু। যে কবিতাটি পেলাম সেটা শুরু হয়েছে এভাবে।–
‘সাতটি বছর গেল পর পর
আজকে পড়েছে আটে
তব জন্মদিন নয়তো মলিন
ভয়াল বিশ্বহাটে।’
যমজ বোন বলেই আমরা দু’জন সব সময় একই কবিতা পেতাম। শুধু কবিতা নয়। গল্পের বইও একই হত। দুজনের জন্যে দুটি শিশু ভোলানাথ কিংবা ঠাকুরমার ঝুলি।
আমরা দু’জন যে দেখতে অবিকল একরকম এ নিয়ে বাবার মধ্যে একটা গোপন গর্ব এবং অহংকার ছিল! নতুবা কেউ এলেই হাসিমুখে বলতেন–এরা যমজ। একজনের নাম রাত্রি, একজনের নাম কান্না। যার চুল ছোট ছোট ও হচ্ছে কান্না। মা বড় বিরক্ত হতেন। ভ্রূ কুঁচকে বলতেন— যমজ মেয়ে নিয়ে এত ঢোল পিটানোর কি আছে? যমজ-ফমজ আমি দুচক্ষে দেখতে পারি না, ছিঃ!
আমাদের দু’জনকে যাতে দেখতে এক রকম না দেখায় এ জন্যে তার চেষ্টার ক্রটি ছিল না। আমার চুল কেটে ছোট ছোট করে দিলেন। একজনের গায়ের রঙ যেন অন্যজনের চেয়ে আলাদা হয় সে জন্যে নীলুকে সপ্তাহে তিন দিন কাঁচা হলুদ দিয়ে গোসল করাতে লাগলেন। কিছুতেই কিছু হল না। আমরা যতই বড় হতে থাকলাম আমাদের চেহারার মিল ততই বাড়তে লাগল। নীলু। যেমন লম্বা। আমিও তেমন লম্বা। তার চিবুকের নিচে যে রকম একটি লাল রঙের তিল আমারও অবিকল সে রকম তিল। তার যেমন শ্যামলা গায়ের রঙ আমার তাই। মা পর্যন্ত ভুল করতে লাগলেন। যেমন একদিন বারান্দায় বসে তেঁতুলের খোসা ছড়াচ্ছি, মা ঝডের মত এসে প্রচণ্ড একটা চড় কষালেন।
এক খিলি পান দিতে বললাম। কতক্ষণ আগে?
আমি শান্ত স্বরে বললাম, আমাকে বলনি। বোধহয় নীলুকে বলেছ। আমি বিলু।
আমার ছোট চুল যখন লম্বা হল তখন দেখা গেল বাবা এবং মা ছাড়া আমাদের কেউ আলাদা করতে পারে না। কেন পারে না সে-ও এক রহস্য। নীলুর সঙ্গে আমার বেশ কিছু অমিল আছে। যেমন নীলুর নাক একটুখানি চাপা। ওর চোখ দুটি একটুখানি উপরের দিকে ওঠানো। তবুও দোতলার নজমুল চাচা আমাদের দুবোনকে যখনি দেখেন তখনি বলেন, কে কোন জন? কে কোন জন? নীলু। তাতে খুব মজা পায়। আমার অবশ্যি রাগ লাগে। এইসব আবার কি ঢং? নজমুল চাচা সব সময়ই ঢং করেন। মা নজমুল চাচাকে সহ্যই করতে পারেন না। নজমুল চাচার গলা শুনলেই মুখ কুঁচকে বলেন, ভাঁড় কোথাকার। সব সময় ভাঁড়ামি।
আমাদের নিয়ে সবচে বেশি ভাঁড়ামি করেন অবশ্যি আমার বড় মামা। দিনাজপুর থেকে বেড়াতে এলেই মহা উৎসাহে আমাদের দু’জনকে সামনে বসিয়ে উঁচু গলায় বলেন, দেখা যাক আমি নীলু বিলুকে আলাদা করতে পারি কি-না। ওয়ান টু থ্রি হুঁ এই জন হচ্ছে আমাদের বিলুমণি। বড় মামা ভাঁড়ামি করলে মা রাগ করতেন না, বরং একটু যেন খুশিই হতেন। সবচে খুশি হত নীলু। সে হেসে কুটিকুটি। নীলুর নাম কান্না না হয়েই ভালই হয়েছে। সে হাসতেই জানে, কাঁদতে জানে না। আমরা যখন ক্লাস সেভেনে উঠলাম নীলু আমার কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেল তার হাসি নিয়ে। যা-ই দেখে তাতেই তার হাসি পায়। মা হয়ত কিছু নিয়ে ধমক দিয়েছেন। সে মুখ ফিরিয়ে হাসি গোপন করবার চেষ্টা করছে। মা কঠিন স্বরে বলছেন, হাসছ কেন তুমি?
কই হাসছি না তো।
মুখ ফেরাও। তাকাও আমার দিকে।
নীলু মুখ ফেরালে আমরা দেখতাম হাসি থামাবার চেষ্টায় তার গাল লালচে হয়ে উঠেছে।
কেন তুমি শুধু শুধু হাসছ? হাসির কি হয়েছে বল তুমি, তোমাকে বলতে হবে।
আর হাসব না। মা! এখন থেকে শুধু কাঁদব।
বলেই সে আমার ফিক করে হেসে ফেলল। মা প্রচণ্ড একটা চড় কষলেন।
বাঁদর কোথাকার। তোমার হাসি আমি ঘুচিয়ে দিচ্ছি দেখ!
নীলুর চোখে জল আসছে কিনা মা দেখতে চেষ্টা করতেন। কোথায় কি? নীলু। এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন কিছুই হয়নি। মা ক্লান্ত হয়ে বলতেন, ঠিক আছে যাও আমার সামনে থেকে।