- বইয়ের নামঃ চৈত্রের দ্বিতীয় দিবস
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অনন্যা
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী, রোম্যান্টিক গল্পের বই
কোম্পানীর বড় সাহেবের পাশে
কোম্পানীর বড় সাহেবের পাশে গাড়িতে চড়া ভয়াবহ কষ্টের ব্যাপার। মানসিক কষ্ট, শারিরীক কষ্ট। চার ঘন্টা ধরে এই কষ্টটাই ফরহাদ করছে। বড় সাহেবের গাড়িতে রংপুর থেকে ঢাকা আসছে। বড় সাহেব সীটে হেলান দিয়ে আছেন। চোখ বন্ধ, তবে তিনি ঘুমুচ্ছেন না। গান শুনছেন। মাঝে মাঝে আংগুলে তাল দিচ্ছেন। ফরহাদ তার পাশে কাঠ হয়ে বসে আছে। তার প্রচন্ড বাথরুম পেয়েছে। সে গাড়ির ড্রাইভারকে বলতে পারছে না, ড্রাইভার সাহেব দুমিনিটের জন্যে গাড়িটা থামান। আমার একটু ইয়ে করা দরকার। বলা সম্ভব না। তার পকেটে বলতে গেলে পুরো এক প্যাকেট সিগারেট! কেনার পর তিনটা মাত্র সিগারেট খাওয়া হয়েছে। এখনো সতেরোটা আছে। কিন্তু খাওয়ার উপায় নেই। চার ঘন্টা হয়ে গেল সে সিগারেট খাচ্ছে না, ভাবাই যায় না।
গাড়ির এসি চলছে। সেই এসি এমনই এসি যে ঠাণ্ডায় শরীর জমে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ফরহাদ ডীপ ফ্রীজের ভেতর বসে আছে। এসি কমানোর কথা ড্রাইভার সাহেবকে বলাই যাবে না। ওরিয়ন ওষুধ কোম্পানীর এমডি জামিলুর রহমান সাহেব গরম সহ্য করতে পারেন না। তার অফিসের ঘরেও এই অবস্থা। ঢুকলে মনে হয় এস্কিমোদের ইগলুতে ঢোকা হয়েছে। অফিস ঘরে ঢুকে দুতিন মিনিট ঠাণ্ডা খাওয়া এক কথা আর চার ঘন্টা ধরে ডীপ ফ্রীজে বসে থাকা অন্য কথা। সেতো আর পচনশীল কোন পদার্থ না, যে তাকে ডীপ ফ্রীজে থাকতে হবে। সে মানুষ।
গাড়ির ট্রাঙ্কে ফরহাদের হ্যান্ড ব্যাগ আছে। হ্যান্ড ব্যাগে চাদর আছে। মাফলার আছে। চাদরটা জড়িয়ে বসে থাকলে জীবন রক্ষা হত। সেটা কোনক্রমে সম্ভব না। গাড়ি থামবে। ড্রাইভারকে নেমে গিয়ে গাড়ির ট্রাঙ্ক খুলতে হবে। ঘটাং করে শব্দ হবে। আবার ট্রাঙ্ক বন্ধ করা হবে। আবার ঘটাং করে শব্দ। বড় সাহেব খুবই বিরক্ত হবেন। তিনি গান শুনছেন। তার গান শোনায় বাধা পড়বে। ফরহাদের কাছে মনে হচ্ছে বড় সাহেব তালকানা। ভুল জায়গায় তাল দিচ্ছেন।
গান বাজছে। সুন্দর সুন্দর সব গান। রবীন্দ্রসংগীত। অন্য সময় এইসব গান। অনেক ভাল লাগত। এখন সহ্যই হচ্ছে না। ফরহাদ একবার অসুস্থ শরীরে ইলিশ মাছ খেয়ে খুব বমি করেছিল। সেই অসুখ কবে সেরে গেছে, কিন্তু ইলিশ মাছ সে এখনো খেতে পারে না। গন্ধ নাকে গেলেই বমি বমি ভাব হয়। এখন মনে হচ্ছে রবীন্দ্রসংগীতের ব্যাপারেও ওই অবস্থা হবে। যতবার রবীন্দ্রসংগীত কানে আসবে ততবারই বমি ভাব চলে আসবে।
ফরহাদের ডান পায়ের হাঁটুতে টনটনে যন্ত্রণা হচ্ছে। পা নাড়াতে পারলে হত। পা নাড়ানো যাচ্ছে না। পায়ের কাছে দুই পাতিল বগুড়ার দৈ। পাতিল যেন উল্টে না যায় তার জন্যে দুপা দিয়ে সামলাতে হচ্ছে।
ড্রাইভারের পাশে বসেছে বড় সাহেবের খাস বেয়ারা মোকাদ্দেস। মোকাদ্দেসেরও পায়ের কাছে দৈ, কোলের উপর দৈ। বড় সাহেব বগুড়ার সব দৈ কিনে ফেলেছেন। বাথটাবে দৈ ঢেলে গোসল করবেন না-কি? পুরানো কালে রাণীরা দুধে গোসল করতেন। এই আমলের বড় সাহেবরা হয়তো দৈ-এ গোসল করেন।
গাড়িতে ওঠার আগে আগে এক বোতল পেপসি খাওয়া বিরাট বোকামী হয়েছে। দু চুমুক খেয়েই আর খেতে ইচ্ছা করছিল না। তবু পয়সায় কেনা জিনিস ফেলতে মায়া লেগেছে বলে খেয়ে ফেলা। এখন মনে হচ্ছে মায়া করা বিরাট বোকামী হয়েছে। বাথরুম এমন চেপেছে যে বলার মত না। এক বোতল পেপসি, সাত বোতল পেচ্ছাব হয়ে চাপ দিচ্ছে। ফরহাদের ইচ্ছে করছে—গাড়িতেই কাণ্ডটা করে ফেলতে। দৈয়ের হাড়িতে পেচ্ছাব ছিটিয়ে দেয়া। পেচ্ছাব মাখা দৈ—খেতে খারাপ হবে না। নোনতা নোনতা স্বাদ হবে। ছিঃ এইসব সে কি ভাবছে? মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে না-কি?
ফরহাদ তার চিন্তা অন্যদিকে নেবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। পেচ্ছাবের কথা কিছুতেই ভাবা যাবে না। যত ভাববে তত সমস্যা হবে। শেষে দেখা যাবে সত্যি সত্যি সে গাড়িতেই কাণ্ডটা করে ফেলেছে।
বড় সাহেব পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিগারেট বের করলেন। সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, ড্রাইভার! গাড়ি সাইড কর।
মীর্জাপুর শালবনের কাছে গাড়ি দাঁড়িয়েছে। মোকাদ্দেস ছুটে নেমে এসে দরজা খুলেছে। কাজটা ফরহাদের করা উচিত ছিল—কিন্তু সে পা নাড়াতে পারছে না। ডান পায়ে ঝি ঝি ধরেছে।
বড় সাহেব বললেন, বাথরুম করা দরকার।
ফরহাদের মনে হল এমন মধুর বাক্য সে তার জীবনে শুনেনি। এখন তাকে অতি দ্রুত একশানে যেতে হবে। সময় নষ্ট করা যাবে না। বড় সাহেব যেদিকে দাঁড়িয়েছেন তার উল্টো দিকে দাঁড়াতে হবে। বড় সাহেবের কাজ শেষ হবার আগেই কাজ শেষ করে গাড়িতে ফিরে আসতে হবে। ঝিঝি ধরা পা টেনে চলাই মুশকিল। রোড ক্রশ করতে হবে। একের পর এক গাড়ি আসছে। চট করে একটা সিগারেট ধরানো যায়। কয়েকটা টান দিতে পারলেও তো লাভ। ফরহাদ পকেটে হাত দিল। তার এমন কপাল যে দেখা যাবে সিগারেট আছে দেয়াশলাই নেই। ফরহাদ অতি দ্রুত মনে মনে বলল, ও আল্লাহপাক দেয়াশলাই যেন থাকে। তার যেমন ভাগ্য দেয়াশলাই অবশ্যই থাকবে না। আর থাকলেও কাঠি থাকবে না। উত্তেজনায় ফরহাদের হাত কাঁপছে। তার ভাগ্য ভাল। সিগারেট ম্যাচ দুইই আছে। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বৃষ্টি মনে হয় নামবে। বৃষ্টি নামলে কি বড় সাহেব এসি বন্ধ করবেন?