- বইয়ের নামঃ শিবাজী
- লেখকের নামঃ যদুনাথ সরকার
- প্রকাশনাঃ দিব্য প্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
০১. মহারাষ্ট্র দেশ ও মারাঠা জাতি
প্রথম অধ্যায় – মহারাষ্ট্র দেশ ও মারাঠা জাতি
দেশের বিস্তৃতি
১৯১১ সালের গণনায় দেখা গেল যে, সমগ্র ভারতবর্ষের সাড়ে একত্রিশ কোটি লোকের মধ্যে প্রায় দুই কোটি নরনারী মারাঠী ভাষা বলে। ইহার মধ্যে এক কোটির কিছু বেশী বোম্বাই প্রদেশে, প্রায় আধ কোটি মধ্যপ্রদেশ ও বেরারে, এবং পঁয়ত্রিশ লক্ষ নিজামের রাজ্যে বাস করে। সিন্ধু বিভাগ বাদ দিলে বোম্বাই প্রদেশের যাহা থাকে তাহার অর্দ্ধেক অধিবাসীর, মধ্যপ্রদেশের এক-তৃতীয়াংশের, এবং নিজাম-রাজ্যের সিকি লোকের মাতৃভাষা মারাঠ। এই ভাষার দিন দিন বিস্তৃতি হইতেছে, কারণ ইহার সাহিত্য বৃহৎ এবং বর্দ্ধিষ্ণু, আর মারাঠারা তেজস্বী উন্নতিশীল জাতি।
প্রকৃত মহারাষ্ট্র দেশ বলিলে বুঝাইত দক্ষিণ-ভারতের উচু জমির পশ্চিম প্রান্তে প্রায় আটাশ হাজার বর্গমাইল হান; অর্থাৎ, নাসিক, পুণা ও সাতারা এই তিন জেলার সমস্তটা, এবং আহমদনগর এবং শোলাপুর জেলার কিছু কিছু-উত্তরে তাপ্তী নদী হইতে দক্ষিণে কৃষ্ণা নদীর আদি শাখা বর্ণা নদী পর্য্যন্ত, এবং পূর্ব্বে সীনা নদী হইতে পশ্চিম দিকে সহ্যাদ্রি (অর্থাৎ পশ্চিম-ঘাট) পর্ব্বতশ্রেণী পর্যন্ত। আর, ঐ সহ্যাদ্রি পার হইয়া আরব-সমুদ্র পর্য্যন্ত বিস্তৃত যে লম্বা ফালি জমি তাহার উত্তরার্দ্ধের নাম কোঁকন, এবং দক্ষিণ ভাগ কানাড়া ও মালবার; এই কোঁকনে থানা, কোলাবা ও রত্নগিরি নামে তিনটি জেলা এবং সংলগ্ন সাবন্ত-বাড়ী নামক দেশী রাজ্য প্রায় দশ হাজার বর্গমাইল ব্যাপিয়া আছে। ইহার অধিকাংশ লোকে এখন মারাঠী বলে, কিন্তু তাহারা সকলেই জাতিতে মারাঠা নহে।
চাষবাস ও জমির অবস্থা
মহারাষ্ট্র দেশে বৃষ্টি বড় কম এবং অনিশ্চিত; এজন্য অল্প শস্য জন্মে, এবং তাহাও অনেক পরিশ্রমের ফলে। কৃষক সারা বৎসর খাটিয়া কোনমতে পেট ভরিবার মত ফসল লাভ করে। ইহাও আবার সকল বৎসরে নহে। যে শুষ্ক পাহাড়ে দেশ, তাহাতে ধান হয় না, গম ও যব জন্মে অত্যন্ত কম। এ দেশের প্রধান ফসল এবং সাধারণ লোকের একমাত্র খাদ্য জোয়ারি, বাজ্রী এবং ভুট্টা। মাঝে মাঝে অনাবৃষ্টিতে এইসব গাছের চারা শুকাইয়া যায়, জমির উপরটা পুড়িয়া ধূলার রং হয়, সবুজ কিছুই বাঁচে না, অসংখ্য নরনারী এবং গরু-বাছুর অনাহারে মারা যায়। এইজন্যই আমরা এতবার দাক্ষিণাত্যে দুর্ভিক্ষের কথা শুনিতে পাই।
পাহাড় বনে ঢাকা অনুর্ব্বর দেশ, কাজেই লোকসংখ্যা বড় কম। উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত সহ্যাদ্রি পর্ব্বতশ্রেণী মেঘ পর্যন্ত মাথা তুলিয়া সমুদ্রে যাইবার পথ রোধ করিয়া দাড়াইয়া আছে, আর এই সহ্যাদ্রি হইতে পূর্ব্বদিকে কতকগুলি শাখা বাহির হইয়াছে। এইরূপে দেশটা অনেক ছোট ছোট অংশে বিভক্ত, প্রতি অংশের তিনদিকে পাহাড়ের দেওয়াল আর মাঝখান দিয়া পূর্ব্বমুখে প্রবাহিত কোন প্রাচীন বেগবতী নদী। এই খণ্ড জেলাগুলিতে মারাঠারা নিভৃতে বাস করিত, বাহিরের জগতের সঙ্গে সম্বন্ধ রাখিত না, কারণ তাহাদের না ছিল ধনধান্য, না ছিল তেমন কিছু শিল্প-বাণিজ্য, না ছিল বণিক, সৈন্য বা পথিককে আকৃষ্ট করিবার মত সমৃদ্ধ রাজধানী। তবে ভারতের পশ্চিম সাগরতীরের বন্দরগুলিতে পৌঁছিতে হইলে এই প্রদেশ পার হইয়া যাইতে হইত।
গিরি-দুর্গ
এই নির্জ্জনবাসের ফলে মারাঠা জাতি স্বভাবতঃই স্বাধীনতাপ্রিয় হইল এবং জাতীয় বিশেষত্ব রক্ষা করিতে পারিল। এই দেশে প্রকৃতিদেবী নিজ হইতে অসংখ্য গিরিদুর্গ গড়িয়া দিয়াছেন, তাহাতে আশ্রয় লইয়া মারাঠারা সহজেই অনেকদিন ধরিয়া আত্মরক্ষা করিতে এবং বহুসংখ্যক আক্রমণকারীকে বাধা দিতে পারিত; অবশেষে শ্রান্ত ক্লান্ত শক্ত অবসন্নমনে ফিরিয়া যাইতে বাধ্য হইত।
পশ্চিমঘাটশ্রেণীর অনেক পর্ব্বতের শিখরদেশ সমতল আর পাশগুলি অনেকদূর পর্যন্ত খাড়া, অথচ তাহাদের উপরে অনেক ঝরণা আছে। অতীত যুগে এই পাহাড়ের গা হইতে ট্র্যাপ প্রস্তর গলিয়া পড়িয়া অতি কঠিন ব্যাসল্ট (কষ্টিপাথর) খাড়া দেওয়াল অথবা স্তূপের আকারে বাহির হইয়াছে, তাহা ভাঙ্গা বা খোঁড়া যায় না। পর্বতের চুড়ায় পৌঁছিবার জন্য পাহাড়ের গায়ে সিঁড়ি কাটিলেই এবং পথরোধের জন্য গোটাকয়েক দরজা গাঁথিলেই, এক একটি সম্পূর্ণ দুর্গ গঠিত হয়, বিশেষ কোন পরিশ্রম বা অর্থব্যয়ের প্রয়োজন হয় না। এরূপ গিরিদুর্গে আশ্রয় লইয়া পাঁচশত লোেক বিশ হাজার শত্রুকে বহুদিন ঠেকাইয়া রাখিতে পারে। অগণিত গিরিদুর্গ দেশময় হড়ান থাকায়, বিনা কামানে মহারাষ্ট্র জয় করা অসাধ্য।
যে দেশের অবস্থা এরূপ, সেখানে কেহই অলস থাকিতে পারে না। প্রাচীন মহারাষ্ট্রে কেহই অকর্মণ্য ছিল না—কেহই পরের পরিশ্রমের ফলে জীবিকা নির্ব্বাহ করিত না; এমন কি গ্রামের জমিদারও (পাটেল বা প্রধান) শাসনকার্য পরিচালনা করিয়া নিজের অন্ন উপার্জ্জন করিতেন। দেশে ধনীর সংখ্যা খুব কম ছিল, এবং তাহারা ব্যবসায়ীশ্রেণীর। জমিদারগণেরও যে গৌরব ছিল তাহা ততটা মজুত টাকার জন্য নহে, যতটা শস্য ও সৈন্য-সংগ্রহের জন্য।
এরূপ সমাজে প্রত্যেক স্ত্রী-পুরুষ কায়িক পরিশ্রম করিতে বাধ্য; সৌখিনতা ও কোমলতার স্থান এখানে নাই। প্রকৃতিদেবীর কঠোর শাসনে সকলকেই কোনমতে সাদাসিদে ধরণে সংসার চালাইতে হইত; সুতরাং তাহাদের মধ্যে বিলাসিতা, অনন্যমনে জ্ঞান বা সুকুমার শিল্পের চর্চ্চা, এমন কি ভব্যতা পর্যন্ত অসম্ভব ছিল। উত্তর-ভারতে মারাঠাপ্রাধান্যের সময় এই বিজেতাদের ব্যবহার দেখিয়া বোধ হইত—তাহারা অহঙ্কারী হঠাৎ বড়লোক, কোমলতা ও ভব্যতাহীন, এমন কি বর্ব্বর। তাহাদের প্রধান ব্যক্তিরাও শিল্পকলা, সামাজিকতা, এবং সৌজন্যের দিকে দৃষ্টিপাত করিত না। ভারতের অনেক প্রদেশে অষ্টাদশ শতাব্দীতে মারাঠা রাজা হইয়াছিল সত্য, কিন্তু তাহারা কোন সুন্দর অট্টালিকা, মনোহর চিত্র বা কারুকার্যময় পুঁথি প্রস্তুত করায় নাই।