- বইয়ের নামঃ এখন তখন মানিক রতন
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ শুদ্ধস্বর
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
১. কুংফু গাড়ি
এখন তখন মানিক রতন – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
প্রথম প্রকাশ প্রথম মুদ্রণ ফেব্রুয়ারি ২০১৪
.
উৎসর্গ
প্রফেসর মোহাম্মদ কায়কোবাদ
সালেহা সুলতানা (এমিলি)
দীর্ঘ প্রবাসজীবন শেষে দেশে ফিরে আসার পর আমার জীবনে যে কয়টি আনন্দময় ঘটনা ঘটেছে তার মাঝে একটি হচ্ছে এই দুজন মানুষের সাথে পরিচয়
.
কুংফু গাড়ি
মানিকের সাথে রতনের পরিচয় হয়েছে প্রায় বছরখানেক আগে। মানিক হচ্ছে একজন কবি আর রতন হচ্ছে একজন বিজ্ঞানী, দুইজনের কাজকর্ম একেবারে আলাদা আলাদা জায়গায়। তাদের কখনো দেখা হওয়ার কথা না। মানিক যখন পুরানো বইয়ের দোকানে উইয়ে খাওয়া বই ঘেঁটে বেড়ায় রতন তখন পুরনো ঢাকার ধোলাইখালে ভাঙা যন্ত্রপাতি টানাটানি করে। বৃষ্টির দিনে মানিক যখন বিছানায় আধশোয়া হয়ে ঢুলুঢুলু চোখে কবিতা পড়ে রতন সেই সময় তার ল্যাবরেটরিতে কোনো একটা বিদঘুঁটে যন্ত্রের উপর উবু হয়ে বসে থাকে। গভীর রাতে মানিক যখন নিউজপ্রিন্টের কাগজে বলপয়েন্ট কলম ঘষে ঘষে উত্তর-আধুনিক কবিতা লেখার চেষ্টা করে রতন তখন কম্পিউটারের সামনে বসে জটিল কোনো যন্ত্রের ডিজাইন করে–কাজেই তাদের দুইজনের দেখা হওয়ার কোনো সুযোগই ছিল না। তারপরেও মানিক আর–রতনের একদিন দেখা হয়ে গেল আর যেভাবে দেখা হলো সেটা রীতিমতো একটা কাহিনি।
ঘটনাটা ঘটেছে এভাবে–মানিক সিলেটে গিয়েছে “তরুণ কবি সম্মেলনে”, টানা দুইদিন আধাখ্যাপা শ খানেক কবির সাথে সময় কাটিয়ে ঢাকা ফেরত যাবার সময় ভাবল শ্রীমঙ্গলের বন থেকে একটু ঘুরে আসবে। সে যেহেতু একজন কবি মানুষ তাই তার গাছপালা-পাখি-প্রজাপতি-নদী মাঠ-আকাশ-মেঘ এইসব দেখতে খুব ভালো লাগে। বেচারার কপাল খারাপ, থাকে ঢাকা শহরে তাই তাকে দেখতে হয় রাস্তা-ঘাট-বাস-টেম্পো ট্রাফিক-জ্যাম আর বদমেজাজি মানুষ। শ্রীমঙ্গল যাবার জন্যে সে তার শান্তিনিকেতনি ব্যাগটা ঘাড়ে ঝুলিয়ে বাসস্টেশনে হাজির হলো, রিকশা থেকে নামার আগেই চারদিক থেকে চারজন মানুষ তাকে ঘিরে ফেলে টানাটানি করতে থাকে। যেই মানুষটার গায়ে মোষের মতো জোর সে কনুই দিয়ে ধাক্কা মেরে অন্যদের সরিয়ে মানিককে ধরে টেনে হিঁচড়ে এনে জোর করে গাদাগাদি করে বোঝাই একটা বাসে ঠেলে ঢুকিয়ে দিল। মানিক ঘটনাটায় এত ভড়কে গেল যে কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারল না। একটু পরে একটু শান্ত হয়ে নরম গলায় বলল, “ভাই, আমাকে এই বাসটিতে কেন তুলে দিলেন?” সে কবি মানুষ তাই কখনো গলা উঁচু করে না কখনো রেগে যায় না।
মোষের মতো মানুষটার অবশ্যি কিছুই শোনার সময় নেই, ঠিক তখন স্কুটার থেকে একজন মানুষ নামছিল তাকে ধরে আনার জন্যে সে ছুটে চলে গেল। মানিক তখন আবার অত্যন্ত দ্রভাবে শুদ্ধভাষায় নরম গলায় মিষ্টিভাবে বাসের হেলপারকে জিজ্ঞেস করল, “ভাই, আমাকে কেন এই বাসটিতে জোর করে তুলে দিল?”
হেলপার খুব মনোযাগ দিয়ে তার কেনে আঙুল দিয়ে প্রচণ্ডবেগে কান চুলকাচ্ছিল, সে একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “এইটা আবার কেমন প্রশ্ন? আপনি বাসে যাবেন সেই জন্যে বাসে তুলেছে। এরোপ্লেনে গেলে এরোপ্লেনে তুলত, জাহাজে গেলে জাহাজে তুলত–“
মানিক বলল, “কিন্তু আমি কোথায় যাব সেটি তো একবারও জানতে চাইলেন না ভাই।”
“সেইটা জানার দরকার কী? এই দেশে যাওয়ার জায়গা একটাই। ঢাকা। সবাই ঢাকা যায়। সবসময় ঢাকা যায়। সকালবেলা ঢাকা যায়, দুপুরবেলা ঢাকা যায়, সন্ধ্যাবেলা ঢাকা যায় মাঝরাত্রেও ঢাকা যায়।”
“আমি তো ভাই ঢাকা যেতে চাইছি না। আমি যাব শ্রীমঙ্গল।”
“ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আপনারে আমাদের কোম্পানির শ্রীমঙ্গলের বাসে তুলে দিমু। ফার্স্টক্লাস বাস, ওড়ায়া নিয়া যাব।”
মানিক কবি মানুষ তাই রাগ হতে পারল না, মিষ্টি করে বলল, “কিন্তু ভাই সেটা তো উল্টো দিকে যাওয়া হলো। তাছাড়া যে বাস রাস্তা দিয়ে উড়ে যায় আমি তো সেই বাসে উঠতে চাই না। বাস যাবে রাস্তা দিয়ে, উড়ে কেন যাবে?”
হেলপার দ্বিগুণ বেগে তার কান চুলকাতে চুলকাতে বলল, “নেন, নেন, প্যাচাল পাইরেন না। যাইতে চাইলে যান না চাইলে নাইমা যান।”
মানিক তর্কবিতর্ক না করে নেমে গেল, তাকে নামতে দেখে অন্য বাসের কয়েকজন তাকে টানাটানি করার চেষ্টা করতে চাইছিল কিন্তু মানিক এবারে আগের থেকে সতর্ক ছিল বলে তারা সুবিধা করতে পারল না।
মানিক তখন শ্রীমঙ্গলের বাসগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। যে বাসগুলোর রঙ ক্যাটক্যাটে বেগুনি কিংবা বিদঘুঁটে হলুদ সেগুলো সে। বাতিল করে দিল। কোনো বাসের ড্রাইভার কিংবা হেলপারের চেহারা পছন্দ না হলেও সে সেই বাসে উঠল না। শেষ পর্যন্ত সে যে বাসটাতে উঠল সেটা মোটামুটি সুন্দর একটা বাস, ড্রাইভারের চেহারায় এক ধরনের গাম্ভীর্য আছে, বাসের সিটগুলো নরম এবং একটু পা ছড়িয়ে বসার ব্যবস্থা আছে। মানিক জানালার কাছে আরাম করে বসে, বাস যখন চলতে থাকে তখন জানালা দিয়ে বাইরের মাঠঘাট নদী গাছ দুরন্ত কিশোর দেখতে তার খুব ভালো লাগে।
বাসটা ছাড়তে একটু দেরি হলো কিন্তু তাতে মানিকের কোনো সমস্যা হলো না, তার কখনো কোনো কিছুতে তাড়াহুড়া থাকে না। বাস যখন শহরটা পার হয়ে গ্রামীণ এলাকায় চলে এল তখন মানিকের ভেতর এক ধরনের শান্তি শান্তি ভাব চলে এল। কিছুক্ষণ সে মনে মনে জীবনানন্দ পাশের কবিতা আওড়াতে থাকে এবং তখন হঠাৎ করে তার মাথায় একটা কবিতার লাইন চলে আসে–”দেখা হবে ঘুংচিতে বেলা হবে অবেলা” কিন্তু সমস্যা হলো ঘুংচি বলে কোনো শব্দ তার জানা নেই। কিন্তু সেটাকে সে মাথা থেকে দূর করতে পারছিল না। যখন প্রায় একটা নতুন শব্দ মাথায় চলে আসছিলো ঠিক তখন হঠাৎ করে বাসটা রাস্তার পাশে থেমে গেল। হেলপার বাসের গায়ে বাবা মারতে মারতে বলল, “লামেন। লামেন। হলে লামেন।”