- বইয়ের নামঃ অবনীল
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ তাম্রলিপি
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
০১. ক্যাপ্টেন বৰ্কেন
ক্যাপ্টেন বৰ্কেন হাত দিয়ে অন্যমনস্কভাবে টেবিলে শব্দ করতে করতে মনিটরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। পেছনে মৃদু একটা শব্দ শুনে মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখেন, মহাকাশযানের শিক্ষানবিশ ক্রু রিরা কন্ট্রোলরুমের পেছনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্যাপ্টেন বৰ্কেন একটু অবাক হয়ে বললেন, তুমি এখানে?
মহামান্য ক্যাপ্টেন, আমাকে এখানে ডিউটি দেওয়া হয়েছে।
ক্যাপ্টেন হাত নেড়ে পুরো ব্যাপারটি উড়িয়ে দেবার মতো করে বললেন, কন্ট্রোলরুমে এখন কোনো কাজ নেই রিরা। তুমি এখন বিশ্রাম নিতে যেতে পার।
ক্যাপ্টেন বৰ্কেন এই মহাকাশযানের দলপতি, তার সাধারণ কথাই আদেশের মতো। রিরার মাথা নুইয়ে অভিবাদন করে চলে যাবার কথা ছিল, কিন্তু সে একটু ইতস্তত করে বলল, আর কিছুক্ষণ এখানে থাকার অনুমতি চাইছি মহামান্য ক্যাপ্টেন।
ক্যাপ্টেন বৰ্কেন একটু অবাক হয়ে কমবয়সী এই মেয়েটির দিকে ভালো করে তাকালেন। কিশোরীর মতো মুখ, হালকা-পাতলা ছিপছিপে শরীর, ছোট করে ছাঁটা বাদামি চুল। বড় বড় চোখে কৌতূহল এবং একধরনের নিস্পাপ সারল্য। জীবনে প্রথমবার মহাকাশযানের দীর্ঘ অভিযানে এসে তার চোখে-মুখে একধরনের উত্তেজনার ছাপ, যেটি অনেক কষ্ট করে ঢেকে রেখে সে একধরনের শান্ত ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। ক্যাপ্টেন বৰ্কেন মনিটর থেকে পা নামিয়ে হালকা গলায় বললেন, কন্ট্রোলরুম হচ্ছে মহাকাশযানের সবচেয়ে আনন্দহীন এবং সবচেয়ে একঘেয়ে জায়গা। তুমি এখানে থেকে কী করবে?
আমার কাছে এটি অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক জায়গা মহামান্য ক্যাপ্টেন। আমাদের একাডেমিতে এসব শিখানো হয়েছে। কিন্তু এই প্রথমবার আমি সত্যিকারের কন্ট্রোলরুম নিজের চোখে দেখছি!
ক্যাপ্টেন বৰ্কেন মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, এস, তা হলে কাছে এসে দেখ!
রিরা মেয়েটি সতর্ক পা ফেলে মনিটরের কাছাকাছি এগিয়ে আসে। ক্যাপ্টেন বৰ্কেন তার পাশের চেয়ারটি ঘুরিয়ে তাকে বসার জায়গা করে দিয়ে বললেন, নাও, এখানে বল।
মহাকাশযানের ক্যাপ্টেনের পাশে বসার সুযোগ পেয়ে রিরার চোখে-মুখে কৃতজ্ঞতার একটা স্পষ্ট ছাপ পড়ল। সে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ মহামান্য ক্যাপ্টেন।
এর মাঝে ধন্যবাদ দেবার কিছু নেই। তুমি নতুন এসেছ বলে সবকিছু এরকম মনে হচ্ছে—দেখতে দেখতে অভ্যাস হয়ে যাবে। একাডেমিতে তোমাদের অনেক আইনানুন। শিখিয়েছে না?
শিখিয়েছে মহামান্য ক্যাপ্টেন।
তুমি দেখবে আমরা এগুলো নিয়ে এখানে মাথা ঘামাই না।
রিরা একটু অবাক হয়ে ক্যাপ্টেন বৰ্কেনের দিকে তাকাল, ক্যাপ্টেন বৰ্কেন একটু হেসে বললেন, সব মানুষের নিজের একটা নিয়ম থাকে। আমার মহাকাশযানের নিয়মটা খুব সহজ।
সেটি কী মহামান্য বর্কেন?
মহাকাশযানটাকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়াটা হচ্ছে আমাদের দায়িত্ব নিয়মগুলো করা হয়েছে সেজন্য। এই নিয়মগুলো অল্পবিস্তর শর্ট সার্কিট করে যদি মহাকাশবানকে আরো সহজে চালানো যায়, আমার আপত্তি কোথায়?
রিরা মুখে এক ধরনের গাম্ভীর্য এনে বলল, আমাদের একাডেমিতে আপনার সম্পর্কে অত্যন্ত উচ্চ ধারণা পোষণ করা হয় মহামান্য ক্যাপ্টেন। আমার খুব সৌভাগ্য যে আমি আপনার মহাকাশযানে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি।
ক্যাপ্টেন বৰ্কেন শব্দ করে হেসে বললেন, আমি খুব নিশ্চিত না যে, তুমি সপ্তাহখানেক পরে এই কথা বলবে। আইনকানুন নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না সত্যি, কিন্তু কাজকর্ম নিয়ে আমি খুব খুঁতখুঁতে! কয়দিন পরেই টের পাবে।
ক্যাপ্টেন বর্কেনের হালকা কথাবার্তা শুনে রিরা এর মাঝে খানিকটা সহজ হয়ে এসেছে এই প্রথমবার তার মুখে হালকা হাসির একটা ছাপ পড়ল, বলল, আমি সেটা টের পাবার জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি ক্যাপ্টেন বৰ্কেন।
চমৎকার। ক্যাপ্টেন বৰ্কেন আঙুল দিয়ে টেবিলে শব্দ করতে করতে বললেন, মহাকাশযানের সমস্যাটা কী জান?
কী মহামান্য ক্যাপ্টেন?
এর সবকিছু নিজে থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এই কন্ট্রোলরুমের মূল যে প্রসেসর, সেটা তোমার কিংবা আমার মস্তিষ্ক থেকে কয়েক হাজার গুণ বেশি শক্তিশালী। কাজেই আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে এখানে কারো কিছু করার নেই। কিন্তু–
ক্যাপ্টেন বৰ্কেন কথা থামিয়ে দিয়ে অন্যমনস্কভাবে মনিটরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। রিরা ধৈর্য ধরে ক্যাপ্টেন বর্কেনের দিকে তাকিয়ে রইল; ক্যাপ্টেন বৰ্কেন একটা নিশ্বাস ফেলে রিরার দিকে তাকিয়ে বললেন, কিন্তু এখানে সব সময় খুব সতর্ক থাকতে হয়, এমন বিচিত্র সমস্যা হতে পারে, যেটা কেউ আগে কোনো দিন চিন্তা করে নি। এখন পর্যন্ত একটি অভিযানও হয় নি যেখানে আমাকে বিচিত্র কিছু করতে হয় নি।
মহামান্য ক্যাপ্টেন।
বলো।
আপনার কি মনে হয় আমাদের এই অভিযানে বিচিত্র কোনো অভিজ্ঞতা হতে পারে?
নিশ্চয়ই হতে পারে রিরা।
সেটি কি বিপজ্জনক কিছু হতে পারে? রিরা তার গলায় একটা স্বাভাবিক ভাব বজায় রাখার চেষ্টা করলেও সেখানে আশঙ্কাটুকু গোপন থাকল না।
ক্যাপ্টেন বৰ্কেন মৃদু হেসে বললেন, বিপজ্জনক তো হতেই পারে রিরা—লক্ষ লক্ষ মাইলের নির্জন মহাকাশে কত কী ঘটতে পারে। কিন্তু তাতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
রিরা সোজা হয়ে বসে বলল, আমি ভয় পাচ্ছি না মহামান্য ক্যাপ্টেন।