- বইয়ের নামঃ অনুরন গোলক
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ বিদ্যাপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
অনুরন গোলক
উত্তরের এক জনাকীর্ণ শহর থেকে পাঁচ জন তরুণ–তরুণী দক্ষিণের এক উষ্ণ অরণ্যাঞ্চলে বেড়াতে এসেছে। তারা হ্রদের শীতল পানিতে পা ডুবিয়ে বড় বড় পাথরের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছিল। উত্তরের যে জনাকীর্ণ শহর থেকে তারা এসেছে সেই শহরে এখন। তুষারভেজা হিমেল বাতাস বইছে হু–হুঁ করে, সেখানে মানুষজন দীর্ঘদিন থেকে শক্ত কংক্রিট ঘরের নিরাপদ উষ্ণতায় বন্দি হয়ে আছে। খোলা আকাশের নিচে হ্রদের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে এই পাঁচ জন তরুণ–তরুণী এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না তারা প্রকৃতির হিমশীতল, ছোবল থেকে এই কোমল উষ্ণতায় সরে এসেছে।
পাঁচ জন তরুণ–তরুণীর মাঝে যে মেয়েটি সবচেয়ে সুন্দরী এবং সে সম্পর্কে সবসময় সচেতন তার নাম রিফা। সে পা দিয়ে পানি ছিটিয়ে বলল, কী সুন্দর জায়গাটা দেখেছ? মনে হচ্ছে ধরে কচকচ করে খেয়ে ফেলি।
ক্রিক নামের সবচেয়ে হাসিখুশি ছেলেটি হেসে বলল, রিফা, তোমার সবকিছুতেই একটা খাওয়ার কথা থাকে লক্ষ করেছ?
ক্রিকের কথা শুনে সবাই অকারণে উচ্চৈঃস্বরে হাসতে থাকে, রিফার গলা উঠল সবার ওপরে। স্বল্পভাষী স্না মাথা নেড়ে বলল, একটা জিনিসকে সত্যিকার অর্থে ভালবাসলে সেটাকে খাওয়ার সাথে তুলনা করতে হয়। খাওয়া হচ্ছে মানুষের আদি আর অকৃত্রিম ভালবাসা।
শু নামের কোমল চেহারার দ্বিতীয় মেয়েটি বলল, তাহলে বলতেই হবে রিফার এই জায়গাটি খুব পছন্দ হয়েছে।
রিফা পা দিয়ে আবার পানি ছিটিয়ে আদুরে গলায় বলল, অবশ্যি পছন্দ হয়েছে। তোমার পছন্দ হয় নি?
শু মাথা নেড়ে নরম গলায় বলল, হয়েছে। তোমার মতো কচকচ করে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে কি না জানি না কিন্তু জায়গাটা অপূর্ব। কী নিরিবিলি দেখেছ?
ক্রিক বলল, আমরা সবাই মিলে যেভাবে চিৎকার করছি জায়গাটা কি আর নিরিবিলি আছে?
শু বলল, তা নেই, কিন্তু এই বিশাল প্রকৃতিকে আমরা কয়েকজন চিৎকার করে কি আর জাগাতে পারব? এ রকম একটা জায়গায় এলে এমনিতেই মন ভালো হয়ে যায়।
শুয়ের গলার স্বরে কিছু একটা ছিল বা এমনিতেই কোনো কারণে হঠাৎ সবাই চুপ করে যায়। শীতল পানিতে পা ডুবিয়ে সবাই চুপচাপ বসে থাকে, হ্রদের তীরে পাইনগাছে বাতাসের সরূসর শব্দ হতে থাকে, পাখির কিচমিচ ডাক কানে আসে এবং মৃদু বাতাসে হ্রদের পানি ছলাৎ ছলাৎ করে পাথরে এসে আছড়ে পড়তে থাকে।
দীর্ঘ সময় সবাই চুপ করে থাকে এবং এক সময় রিফা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমার কী মনে হচ্ছে জান?
শু জিজ্ঞেস করল, কী?
রিফা বলল, আমার মনে হচ্ছে আমরা সবাই বুঝি সেই প্রাচীন যুগের মানুষ হয়ে গেছি। প্রাচীন যুগের মানুষ যেরকম প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকত আমরা বুঝি সেভাবে বেঁচে আছি।
রিফার কথা শুনে স্না হঠাৎ নিচু স্বরে হেসে উঠল। রিফা বলল, কী হল, তুমি হাসছ কেন?
তোমার কথা শুনে হাসছি।
কেন? আমি হাসির কথা কী বলেছি?
তুমি হাসির কথা বল নি? তুমি বলেছ যে তুমি প্রাচীনকালের মানুষের মতো প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে আছ! প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করার মানে কী তুমি জান?
রিফা সরল মুখে জিজ্ঞেস করল, কী?
প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করা মানে–ঝড় এসে ঘরবাড়ি উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া, বন্যা এসে সবকিছু ভাসিয়ে নেয়া, ভূমিকম্পে বিশাল জনপদ ধ্বংস হয়ে যাওয়া। আমাদের কখনো সেরকম কিছু হয় না, এই শতাব্দীতে আমরা প্রকৃতিকে বশ করে আছি। ঝড় ভূমিকম্প বন্যা রিজার্ড আমাদের স্পর্শও করতে পারে না। শুধু তাই না, আকাশ থেকে একটা উল্কাও পৃথিবীতে পৌঁছাতে পারে না, মহাকাশেই সেটাকে ধ্বংস করে দেয়া হয়।
ক্রিক বলল, শুধু কি তাই? এই যে আমরা এক গভীর অরণ্যে হ্রদের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছি, আমরা কি ভয়ে ভয়ে আছি যে গভীর জঙ্গল থেকে একটা বুনো পশু এসে আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে? একটা বিষাক্ত সাপ এসে আমাদের ছোবল দেবে? না, আমাদের মোটেও সেই ভয় নেই! আমাদের ক্যাম্পে যে সনোট্রনটা রয়েছে সেটা প্রতিমুহূর্তে আলট্রাসনিক শব্দ দিয়ে যাবতীয় পশুপাখি জন্তু–জানোয়ারকে দূরে সরিয়ে রাখছে। আমাদের সবার কাছে যে যোগাযোগ মডিউলটা রয়েছে সেটা উপগ্রহের সাথে যোগাযোগ রাখছে, আমাদের যে–কোনো বিপদে এক ডজন হেলিকপ্টার দুই ডজন বাই ভার্বাল শ দুয়েক রবোট ছুটে আসবে। কাজেই রিফা, হ্রদের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে থাকা আর প্রাচীন মানুষের মতো প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করার মাঝে বিশাল পার্থক্য।
রিফা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, কিন্তু আমার মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে করে প্রাচীনকালের মানুষদের বেঁচে থাকতে কেমন লাগত।
ক্রিক সরল মুখে হেসে বলল, আমি দুঃখিত রিফা, তুমি সেটা কখনই জানতে পারবে না।
দলের পঞ্চম সদস্য লন সারাক্ষণ চুপ করে বসেছিল। সে স্বল্পভাষী মানুষ নয় কিন্তু বিশাল এক জনাকীর্ণ শহর থেকে হঠাৎ করে প্রকৃতির এত কাছাকাছি এসে সে এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করছে। বিশাল প্রকৃতি কখন কাকে কীভাবে প্রভাবিত করে বোঝা খুব। মুশকিল। সে এতক্ষণ খুব মনোযোগ দিয়ে সবার কথা শুনছিল, এবারে একটা নিশ্বাস ফেলে। বলল, আমি একটা কথা বলি?