- বইয়ের নামঃ আমি এবং কয়েকটি প্রজাপতি
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী, রহস্যময় গল্প
আমাকে পাগল ভাববেন না
শুরুতেই আপনি আমাকে পাগল ভাববেন না।
শুরুতে পাগল ভাবলে আমার গল্পটা আপনি মন দিয়ে শুনবেন না। আর শুনলেও তেমন গুরুত্ব দেবেন না। জগতের কোনো মানুষ পাগলদের কথা মন দিয়ে শোনে না। এমনকি সাইকিয়াট্রিস্টরাও না। অথচ পাগলদের কথা তাদেরই সবচে’ মন দিয়ে শোনার কথা। ঠিক না?
সাইকিয়াট্রিস্টরা যে পাগলদের কথা মন দিয়ে শুনেন না–তা কী করে টের পেলাম জানেন? আমার স্ত্রী একবার আমাকে এক সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে গেল। সে আগে আমাকে বলে নি কার কাছে নিয়ে যাচ্ছে। শুধু বলেছে তার দূরসম্পর্কের ভাই। আমাদের বিয়ের সময় তিনি দেশে ছিলেন না বলে দেখা হয় নি। এখন দেশে ফিরেছেন। তার সঙ্গে দেখা করা সামাজিক দায়িত্ব।
আমার স্ত্রীর ধারণা ছিল আগে থেকে সাইকিয়াট্রিস্ট বললে আমি হয়তে যেতে চাইব না। যাই হোক, আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে ভদ্রলোকের বাসায় গেলাম। মধ্যবয়স্ক একজন লোক। প্রচুর টাকা-পয়সা আছে বলে মনে হলো। বসার ঘর সুন্দর করে সাজানো। রেনওয়ার কিছু ছবির সুন্দর রিপ্রডাকশন দামি ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে। দেখে হঠাৎ করে মনে হবে অরিজিনাল না।
ভদ্রলোক আমাদের যত্ন করে বসালেন। আন্তরিকভাবে কথা বলা শুর করলেন। আমি ছবি নিয়ে কথা বলছি; ভদ্রলোক হঠাৎ বললেন, এক সেকেন্ড একটা জরুরি টেলিফোন করে আসি, কিছু মনে করবেন না। রাত আটটার টেলিফোন করার কথা। ন’টা বেজে গেছে, আগে খেয়াল করি নি। সরি, সরি।
তিনি টেলিফোন করতে গেলেন, বিশ মিনিট পর ফিরে এসে বললেন তারপর বলুন–আমরা কোথায় ছিলাম যেন?
আমি বললাম, আমরা গত বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে কথা বলছিলাম। জার্মান ফুটবলার বেকেনবাওয়ারকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল।
ও আচ্ছা, বলুন…।
আমি বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে কথা বলতে শুরু করলাম। অথচ আগে ছবি নিয়ে কথা বলছিলাম। প্রসঙ্গ পরিবর্তন ভদ্রলোক ধরতেই পারেন নি, কারণ তিনি গুরুত্ব দিয়ে কিছু শুনছিলেন না।
আমার স্ত্রী আমাকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে গিয়েছিল, কারণ বিয়ের পরপরই তার ধারণা হলো–আমার মাথায় কোনো সমস্যা আছে। এই ধারণা তার হতো না, হয়েছে আমার পারিবারিক ইতিহাসের কারণে। পাগলামির ব্যাপারটা আমাদের পরিবারে আছে। চল্লিশ বছর বয়সে আমার বাবার মস্তিষ্কবিকৃতি হয়। তার চার বছর পর ঢাকার একটা মেন্টাল হোমে তার মৃত্যু ঘটে। আমার দাদিও পাগল ছিলেন। গভীর রাতে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় আমাদের গ্রামের বাড়ির ছাদে চক্রাকারে দৌড়াতেন। এবং খুবই আনন্দিত গলায় চেঁচাতেন–আমি ন্যাংটা, আমি ন্যাংটা।
আমাদের গ্রামের বাড়িটি পাকা এবং চারদিকে উঁচু দেয়াল। তারপরেও দূর থেকে ছাদের দৃশ্য দেখা যায়। কাজেই আমার দাদা পারিবারিক আব্রু বজায় রাখার জন্যে ছাদের রেলিং অনেক উঁচু করে দিলেন।
এ জাতীয় পারিবারিক ইতিহাসের কারণে আমার স্ত্রী যে আমাকে সন্দেহের চোখে দেখবে সেটাই স্বাভাবিক। তার সেই সন্দেহ আরো গাঢ় হলো যখন সে। দেখল, আমার আচার-আচরণ অন্য দশজনের মতো না, খানিকটা আলাদা। যেমন প্রায়ই গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে আমি নিঃশব্দে ছাদে চলে যাই। ছাদে পাটি বিছিয়ে শুয়ে থাকি। তারা ভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে শুয়ে থাকার আনন্দ অধিকাংশ মানুষ জানে না বলে তারা এই কাজটা করে না। এর মধ্যে পাগলামি কিছু নেই। অথচ আমার স্ত্রীর ধারণা–আমার মাথা এলোমেলো। মাথা এলোমেলো না হলে কেউ কি তার নবপরিণীতা স্ত্রী ফেলে ছাদে শুয়ে থাকে?
এক রাতে কী হয়েছে শুনুন। আমি ছাদে শুয়ে আছি, নেমেছে বৃষ্টি। কুকুরবেড়াল টাইপ বৃষ্টি। আমাদের ছাদটা ঢাকার রাস্তার মতো, সামান্য বৃষ্টি হলেই পানি জমে যায়। আমি নাক ভাসিয়ে পানিতে শুয়ে আছি আমার স্ত্রী এসে উপস্থিত। আমাকে দেখে সে আঁতকে উঠে বলল, এসব কী হচ্ছে? আমি বললাম, এসো, আমার পাশে শুয়ে পড়।
সে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, কেন?
আমি বললাম, নাক ভাসিয়ে বৃষ্টির পানিতে শুয়ে থাকলেই বুঝবে–কী হচ্ছে। খুবই মজা হচ্ছে।
সে কী যে অবাক হয়েছিল। তার সেই অবাক দৃষ্টি আমার এখনো মনে আছে। কাউকে অবাক করতে পারলে আমার ভালো লাগে।
বিয়ের পর পর লক্ষ করলাম, আমার স্ত্রী আমাকে খানিকটা ভয় করতে শুরু করেছে। উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা পরিষ্কার করছি। মনে করুন, সে আমার জন্যে চা নিয়ে এসেছে। তখন যদি তার নাম ধরে ডাকি সে এমন চমকে উঠবে যে হাত থেকে চায়ের কাপ উল্টে যাবে। কয়েকবার এরকম হয়েছে। একবার তো গরম চা পড়ে হাতে ফোসকা পড়ে গেল।
আমাদের বারান্দাটা অনেক বড়। সেই বারান্দায় আমি একবার একটা দড়ি সিলিং থেকে লাগাচ্ছি। কাজটা করছি চেয়ারে দাঁড়িয়ে। লক্ষ করলাম রূপা (রূপা আমার স্ত্রীর নাম, আপনাকে এখনো মনে হয় তার নাম বলি নি। না বলার কিছু কারণ আছে বলেই বলি নি। কারণটা একটু পরে বলি?) দূর থেকে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ব্যাপারটা লক্ষ করছে। এক সময় সে কাছে এসে বলল, কী করছ? আমি। বললাম, দড়ি ফিট করছি।
কেন?
ফাঁসিতে ঝুলব বলে ভাবছি। আজ দিনটা শুভ। শুক্রবার। ঝুলে পড়ার জন্য। এরচে’ ভালো দিন হয় না।
রূপা আঁ আঁ করে বিকট চিৎকার করে ফিট হয়ে পড়ে গেল। আমি তাকে। বলার সুযোগই পেলাম না যে কাজটা করছি একটা দোলনা টানানোর জন্যে। বেতের আসবাবপত্রের দোকানে সুন্দর চেয়ার পাওয়া যায়, যা দড়িতে ঝুলিয়ে দিলে ঝুলন্ত চেয়ার হয়। আমার ধারণা হয়েছিল গল্পের বই নিয়ে ঝুলন্ত চেয়ারে বসতে রূপার ভালো লাগবে।