- বইয়ের নামঃ মধ্য বয়সের সঙ্কট
- লেখকের নামঃ মিনা ফারাহ
- প্রকাশনাঃ আগামী প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
০১. মিডলাইফ ক্রাইসিস
প্রথম প্রকাশ : ফাল্গুন ১৪০৯ ফেব্রুয়ারি ২০০৩
উৎসর্গ : মধ্য বয়সের নারী
০১. মিডলাইফ ক্রাইসিস
মানুষের হৃদয় নিয়ে বিরাট একটা বিষয় পড়ে আছে। নিঃসন্দেহে জটিল এই বিষয়টি গভীর গবেষণার দাবিদার হলেও ভলিউমের পর ভলিউম রিসার্চ রিপোর্ট ভিত্তি করে এ লেখা হয়নি। বিষয়টি এমনই জটিল যে-সাধারণ বুদ্ধিতে অন্তত মনে হয় মঙ্গলগ্রহে মনুষ্যপ্রাণীর এই মুহূর্তে গিয়ে বসবাসের সঙ্গে তুলনা করলেও তা যথেষ্ট হবে না। নরম। হৃদয়ের সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলোকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে পণ্ডিত থেকে শুরু করে নিরক্ষর অধিকাংশই ব্যর্থ হয়েছেন। সামাজিক নিয়মনীতির শৃঙ্খলাবদ্ধ করে তার অপব্যাখ্যা ছাড়াও অবিচারও করা হয়েছে প্রচুর।
হ্যাঁ, বলছি প্রেম ভালোবাসার কথা, যখন তাকে বলা হয় অবৈধ। ট্যাবলয়েডের ভাষায় পরকীয়া প্রেম। এখানে বলছি মিডলাইফ ক্রাইসিস। . হৃদয়ের ব্যাপার নিয়ে সামাজিক ভুল বোঝাবুঝি পাহাড়-সমান। প্রেমের সৌন্দর্য অসামাজিক কূপমণ্ডুকতার কারণে অপব্যবহৃত এবং উপেক্ষিত।
প্রেম এবং ভালোবাসা মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি সত্ত্বেও, সামাজিক জীবনে গতানুগতিকতা থেকে একটু বাইরে গেলেই একে নিয়ে খোলাখুলিভাবে টানাহ্যাঁচড়া শুরু হয়। গতানুগতিক বলতে বিয়ে, প্রেম এবং সংসার। বৈধ ম্যারেজ সার্টিফিকেটের ছাতার তলে। গতানুগতিকতার বাইরের প্রেমও যে কত সুন্দর এবং প্রয়োজনীয় হতে পারে আমাদের সমাজ তা স্বীকার করতে এখনও একেবারেই শেখেনি।
মানুষের হৃদয় আছে। হৃদয়ের একটি ব্যাপারও আছে। যার ওপর নিয়ম, বৈধতা, শাসন, রেশন, ক্যাপশন কিছুই চলে না। যুক্তি তো নয়ই। দীর্ঘদিন বিবাহিত জীবনযাপন শেষে কখন যে সেই জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মায় ঘড়ি ধরে তাকে কেউ ব্যাখ্যা দিতে পারে না। কখন যে কার প্রেমের অনুভূতি অন্য আর একজনের জন্যে উদয় হয় সে কথাও নিয়ম করে কেউ বলতে পারে না। তবে অনেকের জীবনেই তা ঘটে যায়। সামাজিক ভাষায় যাকে বলা হয় অবৈধ, কিন্তু অভিজ্ঞদের ধারণায় তা মিডলাইফ ক্রাইসিস। নারী এবং পুরুষের জীবনে এই মিডলাইফ ক্রাইসিস সহসাই আসতে পারে। তবে মধ্যজীবনের আগে নয়। এবং এটা যে কত বড় একটি মানসিক সমস্যা অধিকাংশ মানুষই এখনও তা চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়েছে।
চল্লিশোর্ধ্ব নারী কিংবা পুরুষের জীবনে হঠাই তাদের অজান্তে এমন এক সঙ্কট আসতেই পারে, যার কারণে তারা হারিয়ে ফেলে তাদের পুরনো অনুভূতিগুলো।
ভালোবাসা হারিয়ে যেতে পারে এমনকি পেটের সম্মানের উপরেও। এই ক্রাইসিস অনেকেই লালন করে গোপনে। অনেকেই আবার প্রকাশ্যে। কিন্তু যেভাবেই এই ক্রাইসিস তারা ধারণ করুক না কেন সমাজের চোখে তা সবসময়ই অবৈধ। আমরা খুব পরিচিত এর প্রতিরূপ একটি শব্দের সঙ্গে, ট্যাবলয়েড যাকে বলে পরকীয়া প্রেম। এই হেডলাইনের ব্যানারে অনেক মুখরোচক সংবাদসহ এমনকি আত্মহত্যার সংবাদও প্রায়শই আমাদের চোখে পড়ে।
মধ্য জীবনের সঙ্কট জীবনে যখন উদয় হয় তখন মনে হতেই পারে যেন বিগত বছরগুলো ধরে বিবাহিত জীবনটা ছিল পারদ উঠে যাওয়া আয়নার মতো, যেন সম্পূর্ণ অতীত জীবনই একটা আবছা আয়না।
ইন্টারনেটের যুগে বিশ্ব এখন করতলে। মানুষ মঙ্গল গ্রহে গিয়ে হানিমুনের স্বপ্ন দেখছে। টাইটানিক সমুদ্রগর্ভ থেকে উঠে এসে ডাঙ্গায় বসবাসের কথা ভাবছে। আর উত্তর মেরুতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা এখন বারবিকিউ চিকেন উইং আর বিয়ার হাতে পার্টি করছে। কিন্তু হায়! এই মিডলাইফ ক্রাইসিসের মতো এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার কোনও প্রাধান্যই পেল না!
একটি হৃদয় দ্বিখণ্ডিত। দু’পাত্রে রাখা। রক্ত ঝরছে দু’দিক থেকেই। ভাবল না কেউ দ্বিখণ্ডিত সেই হৃদয়টির কথা। তার ব্যথা। তার কষ্ট। আমি কোনও মনস্তাত্ত্বিক নই। কিন্তু বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এই হার্দিক বিষয়টির বিরুদ্ধে যথেষ্ট অত্যাচার দেখা যায়। অবৈধ প্রেমের কারণে, ভ্যালিড ম্যারিড সার্টিফিকেটের যুক্তি নিয়ে হৃদয়ের অনুভূতির বিরুদ্ধে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অনেক যুদ্ধ দেখা যায়। কিন্তু বিচারকেরা ভুলেই যান যে, জোর করে কাউকে কখনও ভালোবাসানো যায় না। জোর করে মানুষটাকে ঠিকই পাওয়া যায়। কিন্তু তার হৃদয়? অনেকের কাছেই মিডলাইফ ক্রাইসিস কোনও ব্যাপার নয়। ভাবে, সময় দিলেই ঠিক হয়ে যাবে। ভাবে, এটা কোনও সাময়িক অবসেশন। বাস্তবে তা একেবারেই ঠিক নয়।
প্রেম এবং ভালোবাসা ছাড়া মানুষ বাঁচে ঠিকই। কিন্তু প্রেমিক মন প্রেম ছাড়া বাঁচতে পারে না। প্রেমহীন মন এবং হৃদয় মরুভূমিতে শুকিয়ে পড়ে থাকা মৃত ক্যাকটাসের মতো। প্রেমই মানুষকে চিরসবুজ রাখতে পারে। বয়ঃসন্ধিকাল থেকে বয়স্ক, প্রেম যে-কোনও বয়সেই আসতে পারে।
বয়ঃসন্ধিকালের প্রেম: একরকম। শরীরে তখন তারুণ্যের চাঞ্চল্য। হরমোন পরিবর্তনের সময়। সে সময়কার প্রেম যতটা মানসিক তার চেয়েও বেশি শারীরিক। প্রি-টিন, টিন এবং পোস্ট টিন-এজের প্রেম জীবনের যে বয়সে ঘটে, মিডলাইফ থেকে তা অনেক আগের ঘটে-যাওয়া ঘটনা। এবং সেই শুরু থেকেই মিডলাইফ অবধি, জীবন বলতে গেলে একটা প্রায় সমান্তরাল ধাচে চলতে থাকে। মনে হয় এই অনুভূতি চিরকালের। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, সংসারে একটি সন্তান আসার সঙ্গে সঙ্গেই সেই ভালোবাসা ভাগ হয়ে যায়। দীর্ঘদিন একসঙ্গে থেকে এককালের লাইলী-মজনু হয়ে পড়ে অনেকটা ভাইবোনের মতো। বিয়ের দু’বছর পর কিংবা প্রথম সন্তান জন্মানোর পরেই তারা গোয় দেয়ালের দিকে মুখ দিয়ে। একে অন্যের দিকে পিঠ ফিরিয়ে। বিছানায় যাওয়াটা তাদের একটি রুটিন, স্বামী-স্ত্রী। তারা দুটো যন্ত্র, সংসার তাদের যুদ্ধক্ষেত্র। তখন প্রেম পালিয়ে যায় জানালা দিয়ে।