- বইয়ের নামঃ জীবন আমার বোন
- লেখকের নামঃ মাহমুদুল হক
- প্রকাশনাঃ সাহিত্য প্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. শেষ পর্যন্ত বাবুর নিদ্রাভঙ্গ হলো
শেষ পর্যন্ত বাবুর নিদ্রাভঙ্গ হলো তাহলে! আমি তো ভেবেছিলাম এ যাত্রায় বিছানা-বালিশ জব্দ করার পালাটা আরো বেশ কিছুদিন ধরে চলবে।
বড় বড় চোখে রঞ্জুর দিকে তাকালো খোকা। বললে, কি বলতে চাস পষ্টাপষ্টি বলে ফ্যাল। এমনভাবে রোয়াব দেখাচ্ছিস যে এসবে তোর রাজ-রাজেশ্বরীর মাথাটা একেবারে কাটা যায়।
আরেববাস! অমনি তা-ছোটা মুরগির মতো ঝট পটানি শুর হয়ে গেল!
দ্যাখ রঞ্জু, বেশি ফাজলামি মারবি না বলে দিচ্ছি! দিন দিন তোর পাকামির মাত্রাটা অসম্ভব বেড়ে যাচ্ছে; বড়-ছোটর মান্য নেই। কি ঠাউরেছিস আমাকে?
তোর মাথায় নির্ঘাত ছিট হয়েছে। তোশক-বালিশে তা দিয়ে যে হারে ন্যালাখ্যাপার মতো ছারপোকার বংশবৃদ্ধি করে চলেছিস তাতে কোনো ভদ্রলোক আর এ বাড়ি মাড়াবে না।
বুঝেছি। তাতে তোর বেজায় লোকসান।
রঞ্জু হেসে বললে, রাখ, চান্স পেলে কানকো মারা বের করবো একদিন। চোত মাসের কই কোথাকার!
মায়ের কথা মনে পড়লো খোকার ঝট করে। খুব ছোটবেলায় তার লিকলিকে হাত-পা আর হাড় জিরজিরে শরীরের তুলনায় বেঢপ হেঁড়ে মাথার জন্যে যশুরে কই বলে ডাকতো মা, ওটা নাকি বিদ্যাসাগরের ছেলেবেলার নাম। কিন্তু রঞ্জু… কোথা থেকে এসব পায় রঞ্জু!
বিছানার ময়লা চাঁদরের খুঁট ধরে জাল টেনে তোলার মতো ধীরে ধীরে খুব সন্তর্পণে তুললো সেটা রঞ্জু। অভিধানসহ ইংরেজি-বাংলা গোটা তিনেক বই, সিগ্রেটের প্যাকেট, দেশলাই, খোকার ব্যবহৃত গুচ্ছের আলতু-ফালতু জিনিস জালের সুতো থেকে মাছ বাছাই করার মতো একটা একটা করে টিপয়ের উপরে রাখলো। চাদরটা মেঝেয় ছুড়ে দিয়ে বালিশের গায়ে ময়দা ঠাসার মতো করে ঘুসি বসালো কয়েকটা। তারপর এপিঠ-ওপিঠ থাবড়া মেরে সেটাকে যথাস্থানে রেখে বিছানার তলা থেকে দলামোচড়া রুমাল, হিজিবিজি কাটা কাগজ, এটা-সেটা টেনে বের করতে করতে বললে, নাহ্, সত্যি তোকে এ বাড়িতে এক্কেবারেই মানায় না; তুই বরং…
ই-য়াহ্! পোয়াবারো আর কি তোমার! একটা কাঁট বেল্লিক!
অতো ঝাল লগড়াচ্ছিস কেন আমাকে নিয়ে? তোর মতো এই এলুম বলে মাঝরাতে দেবদাস হয়ে ঘরে ফিরি না, আবার গাঁটে গাঁটে রসবাত ধরা পর্যন্ত একনাগাড়ে পাঁচ-সাতদিন বিছানায় সাঁতারও দিই না, চোর-চোট্টা-হাজতির মতো আমার দাড়ি-গোঁফও নেই, দাঁতে মাখনের পলেস্তারাও জমে না তোর মতো! ইশ, গায়ের বোঁটকা গন্ধ নিয়ে, দাঁত মেজে, দাড়ি না কামিয়ে, পানি না ছুঁয়ে থাকিস কি করে? তোর মতো পিপুফিশু আমি কোথাও দেখিনি।
কী-ইবা এমন দেখেছিস তুই, বয়েস তো আধপাতা! বেশি গার্জেনি ফলাতে আসবি তো শালার কষে এইসা রদ্দা লাগাবো যে ফিঁয়াসের নামতক ভুলে যাবি।
কি বললি?
ফিঁয়াসে ফিঁয়াসে! কেন মুরগির মগজে ঢোকেনি বুঝি? জানি। মানে ভাতারের নাম নজ্জায় ধরি না, রাখ, তোর ন্যাকামি একদিন বার করবো!
তোর দাদাগিরির আমি কানাকড়ি দাম দিই কি না। তোদের মতো আমি লোচ্চা-বেলেল্লা নাকি, যে স্রেফ ফিঁয়াসে জুটিয়ে বেড়াবো?
তা ঐ বহুবচনের মানেটা কি?
তুই আর তোর ইয়ার-বন্ধুরা!
যোগ্যতা থাকলে তবে না জোটাবি। ফিঁয়াসে তো আর গাছের শুকনো পাতা নয় যে ডাল ধরে নিছক হুপহুপ বাঁদরামি করে নাড়া দিবি আর ঝুরঝুর ঝরে পড়বে। যোগ্যতার মধ্যে ওই একটাই, অযথা খুনসুড়ি পাকানো। কি কূটকচালে ছুঁড়িরে বাবা! যা, দাড়ি কামাবো, ঝট করে পানি নিয়ে আয়।
সবকিছু নিয়েই তো দিব্যি আঁক করে গেড়ে বসা হয়েছে, পানিটুকু নিয়ে বসলে গতরের এমন কিছু খেয়ানত হতো না।
বহুৎ লেকচার ঝেড়েছিস, এবার কাজ কর। একটু নাই দিয়েছি কি দিয়েছি অমনি মুখে খৈ ফুটতে শুরু করেছে। কাজ আছে, বাইরে বেরুতে হবে, নে নে, ঝটপট, জলদি ক্রো জলদি ক্রো…
গায়ে টিকে তোলা কাচের বাটিতে খানিকটা পানি নিয়ে এলো রঞ্জু; খোকা তখন পানপাতার মতো একটা আয়না চকচকে স্ট্যান্ডের ওপর এঁটে গালে হাত বুলিয়ে মাত্র কদিনের অযত্নে লালিত ভয়ানক রকমের রুক্ষ আর তীক্ষ্ণ আদল টিপে টিপে নিরিখ করছিলো।
ঠিক যেন একটা গাঁজাখোর! যা চোয়াড়ে মার্কা চেহারা হচ্ছে না তোর দিন দিন। ভালো করে ঠাহর করতে পারছিস কাচের হার্টে, না লাইট জ্বেলে দেব?
ঠাহর কি বে? ঠাহর কি? কথার কি ছিরি, কড়ে আঙুলের মতো পুঁচকে ছুঁড়ি, তার আবার কথার বহর কত! ঠাহর, চোয়াড়ে, গতর, ঝাল লগড়ানি, কানকো মারা, পানিওয়ালী মাতারি কোথাকার।
দেয়াল থেকে ক্যালেন্ডার নামিয়ে ঝেড়ে–পোঁছে একটা পাতা উল্টিয়ে সেটাকে আবার যথাস্থানে ঝুলিয়ে রাখলো রঞ্জু। এই মুহূর্তে তাকে নিদারুণ চিন্তাক্লিষ্ট আর গম্ভীর দেখায়। দাড়ি চাচতে চাচতে আড়চোখে একবার দেখলো খোকা। আজকাল প্রায়ই তার মনে হয় রঞ্জু ইতোমধ্যেই বয়েসের তুলনায় মাত্রা ছাড়া গাম্ভীর্য কুক্ষিগত করে ফেলেছে। সাংসারিকতাকে ঠিক দায়ী করা যায় না এ জন্যে, হিসেব করে দেখেছে খোকা, টোল নেই রঞ্জুর গাম্ভীর্যে, কোনো ছিদ্র নেই, মনে হয় সন্ন্যাসিনী; দুটি আয়ত চোখ মেলে রহস্যময় অচেনা ঘুলঘুলিতে সবসময় কিছু একটা খুঁজে বেড়ায় সে।
জানিস দাদা, কদিন থেকে আমার শুধু মনে হচ্ছে অন্যান্যবার যা হয় এবার তা হবে না, বাপি সময়মতো এসে পৌঁছুতে পারবে না, তুই দেখিস… এ কথায় তার গলায় বিষাদ ঝরে পড়ে।