- বইয়ের নামঃ ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন
- লেখকের নামঃ মনোরঞ্জন ব্যাপারী
- প্রকাশনাঃ দে পাবলিকেশন্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ আত্মজীবনী
০০. লেখকের দু’কথা
ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন – মনোরঞ্জন ব্যাপারী
পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাডেমি সুপ্রভা মজুমদার স্মারক পুরষ্কার প্রাপ্ত
দে পাবলিকেশনস ১৩, বঞ্চিম স্যাল স্ট্রট কলকা-৭০০০৫৭
.
উৎসর্গ : আমার এগিয়ে চলার পথের পরমপ্রেরণা দাত্রী মহাশ্বেতা দেবী ও শ্রদ্ধেয় শঙ্খ ঘোষকে
.
মনোরঞ্জন ব্যাপারী আমার অনেক বছরের চেনা সেই লেখক, যাকে আমি লেখক হয়ে উঠতে দেখেছি। লিখতে লিখতে লেখক হয়। এইকথাও মনোরঞ্জন নিজের জীবন ও কর্মে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
“ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন” নামকরণটিও সার্থক। আজকের সমাজে স্বীকৃতি পেতে হলে জন্মসুত্রে কেউ ব্রাহ্মণ, না চণ্ডাল, সে বিচার করার মানসিকতা আর নেই। তবু, জন্মসূত্রে কেউ চণ্ডাল হয়ে থাকেন, তাঁর এগিয়ে যাবার পথটা হয়তো আজও কুসুমাস্তীর্ণ নয়।
মনোরঞ্জনের বইয়ের নাম “ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন” কিন্তু এটা তো আজও সত্য, যে শুধুই নিজের যোগ্যতার ভিত্তিতে সমাজে পরিচিতি গড়ে তোলা কঠিন।
জন্ম বা পরিবার সূত্রে যার পরিচিতি নেই, তার পক্ষে আত্মপরিচয়-এর ভিত্তিতে পরিচিতি গড়ে তোলা সম্ভবত আরও কঠিন।
মনোরঞ্জন ব্যাপারী একেবারেই স্বপরিচয়ে স্বীকৃতি পেতে চান। এই দাবী অভিনন্দনীয়। আমার অনুরোধ, সবাই তার আত্মজীবনীটি পড়ুন, এবং অন্যদের পড়ান।
মহাশ্বেতা দেবী
.
ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন বইটির প্রথম খণ্ড পড়ে মনের মধ্যে একটা বিদ্যুৎচমক তৈরি হয়েছিল। আঘাতে আর দীপ্তিতে পূর্ণ এ রকম একখানা বই লিখলেন সমাজের একজন অবহেলিত মানুষ, লিখলেন তার নিজের কটু–কিন্তু অপরাজেয়–অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণ রূপটি। শুধু সেই অভিজ্ঞতার বৈশিষ্ট্যেই নয়, রচনার কুশলতাতেও সে-বই ছিল মুগ্ধ করার মতো। জনে-জনে পড়াতে ইচ্ছে হয়েছে বইটি।
সে-বইয়ের লেখক মনোরঞ্জন ব্যাপারী আজ এক সুপরিচিত নাম। শুধু ওই লেখাটিতেই নয়, আরো বেশ কিছু গল্পকাহিনি লিখে এতদিনে পাঠকসমাজে এক আদৃত মানুষ তিনি।
তাঁর রচনা-উত্তরকালীন জীবনের কিছু নতুন দেখাশোনা আর ভাবনাচিন্তা এর মধ্যে ধরা আছে, আছে অবশ্য আগেকার জীবনেরও ফেলে আসা কিছু কথা। এবারে তিনি এসে পড়েছেন যে সংস্কৃতি সমাজের বা লেখকসমাজের বৃত্তে, সেখানেও আছে কিছু প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে অবধারিত কিছু লাঞ্ছনারও ইতিহাস, আমাদের গোটা সমাজটাকে স্পষ্টভাবে দেখার বা দেখাবার আয়োজন এর মধ্যে আছেছড়িয়ে। তবে, তিনি আজ নিজেই এক স্রষ্টা বলে তাকে নিশ্চয় মনে রাখতে হবে, শিল্পসমাজ থেকে বিশেষ কিছু প্রত্যাশা, নির্মম প্রত্যাখ্যান লেখকের পক্ষে কখনো-কখনো অনিবার্য। এমনকী, কখনো-কখনো তা হয়তো উপকারীও। নিজের লেখায় মগ্ন থাকলে লেখক এর সব কিছুই একদিন ভুলে যেতে পারেন।
মনোরঞ্জন আরো দেখুন, কেননা দেখার চোখ আছে তার। আরো লিখুন, কেননা লেখার হাত আছে তাঁর। পাঠক হিসাবে আমরা আরো প্রতীক্ষা করে থাকব।
শঙ্খ ঘোষ
.
লেখকের দু’কথা
উনিশশো একাশি সাল থেকে দুহাজার ষোল, সময়ের হিসাবে ৩৪/৩৫ বছর। আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয়–এতগুলো বছর ধরে কাগজ কলমের সাথে কসরত করে কি লিখেছি আমি! গল্প? উপন্যাস?
আমার জবাব হবে, ও সব কিছুই নয়, আমি জীবন লিখেছি। শুধুমাত্র একটা জীবন। তার এগিয়ে চলা। পিছিয়ে পড়া। হেরে যাওয়া, হারিয়ে দেওয়া, হারিয়ে যাওয়া। হারিয়ে গিয়ে খুঁজে পাওয়া। আঘাতে ঠোক্করে ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত হওয়া। আছাড় খেয়ে মাটিতে পতিত হয়ে আবার সেই মাটিকে অবলম্বন করে উঠে দাঁড়াবার প্রয়াস! আকাশকে ছুঁয়ে দেবার দুর্বার অভীপ্সা-ইত্যাদি।
তাই এ কথা বলা খুব একটা অযৌক্তিক হবে না–আমার প্রতিটা কথা কাহিনিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আমারই গোটা জীবন।
কেউ কেউ এটাকে রচনার একটা দুর্বল দিক বলে চিহ্নিত করতে পারেন! যেটা খুব একটা ভুল হবে না। আমি সেই দুর্বলতার নির্মম শিকার। শত চেষ্টায় কিছুতেই যা থেকে বিমুক্ত করতে পারিনি নিজেকে। আসলে নিজের জীবনটুকু ছাড়া আর তো বিশেষ কিছু ছিল না। এইটুকু ছাড়া আজও অন্য কিছু নেই আমার নাগালের সীমায়।
জীবনে যত কিছু পাঠ, যা কিছু আহরণ এবং সঞ্চয় সব পেয়েছি জীবনেরই কাছ থেকে। জীবনই আমার পুঁথি পুস্তক, আমার শিক্ষক-গুরু-মার্গ দর্শক। ও ছাড়া আর কেউ নেই, কিছু নেই। তাই যা দু লাইন লিখেছি সব জীবন থেকে শেখা, জীবন থেকে জানা, জীবন থেকে পাওয়া, জীবন থেকে নেওয়া জীবনের কথা। সে জীবন-কথা কাহিনির মধ্যে খণ্ড খণ্ড হয়ে ছড়িয়ে যাওয়া একান্তই আমার জীবন! আমার দৃষ্টির জীবন। আমি লিখতে বসলেই কলমের ডগায় এসে পড়েছে। শুধু আমারই বহুধা বিভাজিত জীবন গাথা। বঞ্চিত-বিড়ম্বিত জীবন গাথা।
নব নামের সেই যে রিক্সাওয়ালা, লাথখোর নামের সেই যে ট্রাক খালাসি, জীবন নামের ক্রোধী-চণ্ডাল, গুড়জল নামের মদখোর, ভগবান নামের সেই চোর, শ্রীপদ নামের মুটে, আগন্তক পরিচয়ের সেই যে ডাকাত, বাঙাল নামের লেখক–সব আমি। এরা সবাই আমার খণ্ডিত সত্ত্বা।
এই সব কথা-কাহিনী কতখানি সাহিত্যগুণে সমৃদ্ধ তা আমার পক্ষে বলা একটু কঠিন। সে বিচারের ভার বিদগ্ধ পাঠক-সমালোচকদের ওপর ন্যস্ত। আমি শুধু এইটুকু জোরের সাথে বলতে পারি–ওতে সত্য আছে। নিটোল নির্মম অপ্রিয় সত্য। যে সত্যের শরীরে কোন পোষাক নেই।