- বইয়ের নামঃ বেগম মেরী বিশ্বাস
- লেখকের নামঃ বিমল মিত্র
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. আদিপর্ব
বেগম মেরী বিশ্বাস – উপন্যাস – বিমল মিত্র
আদিপর্ব
প্রথমে বন্দনা করি দেব গণপতি।
তারপরে বন্দিলাম মাতা বসুমতি ॥
পুবেতে বন্দনা করি পুবের দিবাকর।
পশ্চিমেতে বন্দিলাম পাঁচ পয়গম্বর ॥
উত্তরেতে হিমালয় বন্দনা করিয়া।
দক্ষিণেতে বন্দিলাম সিন্ধুর দরিয়া ॥
সর্বশেষে বন্দিলাম ফিরিঙ্গি কোম্পানি।
কলিযুগে তরাইল পাপী তাপী প্রাণী ॥
দেওয়ান গেল ফৌজদার গেল গেল সুবাদার।
কোম্পানির সাহেব আইল কলির অবতার ॥
ধর্ম কর্ম ইষ্টিমন্ত্র হইল রসাতল।
হরি হরি বল রে ভাই, হরি হরি বল ॥
এখানেই শেষ নয়, আরও আছে। কোন কালে কোন এক নগণ্য গ্রাম্য কবি ছড়া লিখতে গিয়ে সকলকে বন্দনা করে নিজের খ্যাতি অক্ষয় করতে চেয়েছিল। সবটা পাওয়া যায় না। ছেঁড়াখোঁড়া তুলোট কাগজ। গোটা গোটা ভুষোকালিতে লেখা অক্ষর। পড়বার সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু মনটা একেবারে দু’শো-তিনশো বছর পেছিয়ে চলে যায়। মনে হয়, যেন চোখের সামনে সব দেখছি।
শুধু যুগ নয়, মানুষগুলোও সব আলাদা। সেই খালি গা, মালকোঁচা বাঁধা কাপড়। কারও হাতে লাঠি, কারও গায়ে চাদর। মাথায় কারও আবার টিকি, নইলে ব্রাহ্মণ বলে আপনাকে চিনতে পারব কী করে ঠাকুরমশাই?
আমরা কি আজকের মানুষ নাকি হে? সাতশো বছর আগের আমাদের পরিচয় আমরাই আগে জানতাম না। জানতে পারলাম প্রথম ইবন বতুতার বৃত্তান্ত থেকে। খোরাসানবাসীরা এই বাংলাদেশকে বলত–দুজাখস্ত-পুর-ই-নি-আমত। মানে সুখের নরক। এমন সুখের নরক নাকি সেযুগে আর ভূ-ভারতে কোথাও ছিল না। চূড়ান্ত সস্তাগণ্ডার দেশ। যত ইচ্ছে খাও দাও, ফুর্তি করো। বেশি পয়সা খরচ নেই। বছরে বাড়িভাড়া মাত্র আট দিরাম, মানে বারো আনা। বাজারে চাল-ডাল তেল-নুনের সঙ্গে রূপসি মেয়েও বিক্রি হচ্ছে। বেশি দাম পড়বে না। একটা মোহর দিলেই তোমার কেনা বাদি হয়ে রইল। তোমার বাড়িতে এসে তোমার কাজকর্ম করবে, তোমার গা-মাথা-পা টিপে দেবে। দরকার হলে তোমার বিছানাতেও শোবে। বড় ধর্মভীরু জাত আমরা। আমাদের ওপর দিয়ে তাই কত রকম ঝড়ঝাপটা গেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী।
ইবন্ বতুতা লিখেছেন–have seen no country in the world where provisions are cheaper than this.
মার্কো পোলো, ভাস্কোডাগামা সবাই বাংলাদেশ সম্বন্ধে লিখেছে বটে, কিন্তু সশরীরে আসেনি কেউ এখানে। কিন্তু তাদের লেখা পড়ে এখানে একবার যারা এসেছে তারা আর ফিরে যায়নি। এমন সোনার দেশ কোথায় পাবে শুনি?
এখানকার শুয়োরের মাংস খেয়ে পর্তুগিজরা তো আর নড়তেই চায় না। বলে–ভেরি গুড হ্যাম। এখানকার তাঁতিদের হাতে বোনা কাপড় দেখে বলে–আঃ, ভেরি ফাইন ক্লথ। বাদশা জাহাঙ্গির এই কাপড় পরেছে, বেগম নুরজাহানও এই কাপড় পরেছে। এখান থেকে কাপড় চালান গেছে রোমে, প্যারিসে, বার্লিনে। এবার সোরা। কামান দাগতে গেলে বারুদ লাগে। আর সোরা না হলে আবার বারুদ হয় না। সেই সোরা কিনতে এল ফিরিঙ্গি কোম্পানি। ওলন্দাজ, ফরাসি, পর্তুগিজ আর ইংরেজদের দল।
তারা বললে–আমরা এখানে কারবার করতে এসেছি জাঁহাপনা–আমাদের মেহেরবানি করুন–
বাংলার লাটসাহেব হয়ে এসেছিল বাদশার ছেলে সাহ্ সুজা। সুজার মেয়ের অসুখ। সে আর কিছুতে সারে না। হাকিম হার মেনেছে। কবিরাজও হার মেনেছে। শেষকালে সাহেব ডাক্তারের ডাক পড়ল। ডাক্তার গেব্রিয়াল ব্রাউটনকে ডেকে পাঠানো হল রাজমহলে। বাদশা সাহজাহানের মেয়েকে সারিয়েছে। আর বাদশাজাদার মেয়েকে সারাতে পারবে না! তা কি হয়?
তা সেই যে বাদশার মেয়ের রোগ সারল সেই তখন থেকেই শুরু হল ফিরিঙ্গি পত্তন। বাংলা কি আর ছোটখাটো দেশ গো? না বাঙালিরাই ছোটখাটো জাত। সেই সব অঞ্চলের যত নবাবি আমলা ছিল সকলের কাছে গিয়ে হাজির হল বাদশাহি ফার্মান। ফার্মানে লেখা হল–
জমিদার, চৌধুরী, তালুকদার, মাস্কুদ্দেম, রেকায়া প্রভৃতি
বরাবরেষু–
বাদশার ফার্মান অনুসারে এতদ্বারা সকলকে জ্ঞাত করা যাইতেছে যে, এখন অবধি ইংরাজ কোম্পানি যে-সকল পণ্য জলে ও স্থলে আমদানি ও রপ্তানি করিবে তাহার জন্য কোনও প্রকার শুল্কের দাবি যেন কোনও ইংরাজ কুঠিতে না করা হয়। ইংরেজরা রাজ্যের যে-কোনও স্থানে তাহাদের যে-কোনও পণ্য লইয়া যাইবে বা দেশীয় পণ্য কিনিয়া আনিবে, তাহার শুল্ক কম হইয়াছে বলিয়া যেন তাহা খুলিয়া দেখা বা বলপূর্বক বাজেয়াপ্ত করা না হয়। তাহারা সকল স্থানে বিনা শুল্কে অবাধে বাণিজ্য করিবে। এতদিন তাহাদের নিকট হইতে বন্দরে জাহাজ নোঙর করিয়া থাকার জন্য যেরূপ মাশুল আদায় করা হইত এখন যেন আর তাহাদিগকে সেরূপ না করা হয়। ইত্যাদি ইত্যাদি–
অনেক পুরনো কথা, অনেক পুরনো কাহিনী লেখা রয়েছে তুলোট কাগজের পাতায়। বেশ ভারী পুঁথি। অর্ধেকের ওপর পোকায় খাওয়া, ধুলো জমে জমে ময়লা হয়ে নোনা ধরে গেছে। খেরো খাতায় বাঁধানো ছিল পুঁথিখানা। কার লেখা, পুঁথির নাম কী, তা জানবারও উপায় নেই।
আমি জিজ্ঞেস করলাম–এ পুঁথি আপনি কোথায় পেলেন?
বৃদ্ধ ভদ্রলোক। এককালে অবস্থা ভাল ছিল। বিরাট বাড়ি। সরু-সরু পাতলা-পাতলা নোনা-ধরা ইট। একসঙ্গে পুরো বাড়িটা হয়নি। পুরুষানুক্রমে এক মহলের পর আর এক মহল উঠেছে। একদিকটা নতুন করে মেরামত করা হয়েছে, কিন্তু অন্য দিকের শরিকের হয়তো টাকা নেই তাই সেদিকটা ভেঙে ভেঙে পড়ছে। এক ঘরে রেডিয়ো বাজছে। ইলেকট্রিক লাইটের রোশনাই। আবার ঠিক তার পাশের ঘরটাতেই অন্ধকার ঘুরঘুট্টি। কেরোসিন তেলের হারিকেন জ্বলছে টিমটিম করে। সেই টিমটিমে আলোতেই বাড়ির ছেলেরা মাদুরের ওপর বসে দুলে দুলে নামতা পড়ছে। বাড়ির একতলার ঘরগুলো রাস্তা থেকেও নিচু। যেদিন গঙ্গায় বান ডাকে সেদিন জল ঢুকে পড়ে বাড়ির একতলায় শোবার ঘরে। সেই জলের সঙ্গে কখনও কখনও সাপও ঢোকে। ভাঙা ইটের দেয়াল থেকে কাঁকড়া বিছে বেরিয়ে পড়ে। তখন আর একতলার ঘরে কারও থাকা সম্ভব হয় না। বাক্স-প্যাটরা বিছানা নিয়ে পাশের কোনও শরিকের ঘরে গিয়ে তাদের আশ্রয় নিতে হয়।