- বইয়ের নামঃ দম্পতি
- লেখকের নামঃ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ রহমান বুকস
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১-২. চুয়াডাঙ্গা যাইবার বড় রাস্তা
দম্পতি – উপন্যাস – বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়
চুয়াডাঙ্গা যাইবার বড় রাস্তার দু’পাশে দুইখানি গ্রাম– দক্ষিণপাড়া ও উত্তরপাড়া। দক্ষিণ-পাড়ায় মাত্র সাত-আট ঘর ব্রাহ্মণের বাস, আর বনিয়াদী কায়স্থ বসু-পরিবার এ-গ্রামের জমিদার। উত্তরপাড়ার বাসিন্দারা বিভিন্ন জাতির। ইঁহাদের জমিদারও কায়স্থ। উপাধি–বসু। উভয় ঘরই পরস্পরের জ্ঞাতি। বসুগণ গ্রামের মধ্যে বর্ধিষ্ণু, কিন্তু দুঃখের বিষয়, ইঁহাদের কাহারও মধ্যে সদ্ভাব নাই। রেষারেষি ও মনোমালিন্য লাগিয়াই আছে।
দক্ষিণপাড়ার নীচে ‘কুসুম বামনীর দ’ নামে একটি প্রকাণ্ড পুরাতন জলাশয়ের ভাগবাঁটোয়ারা লইয়া উভয় ঘরের মধ্যে আজ প্রায় দশ বৎসরে পূর্বে প্রথম ঝগড়ার সূত্রপাত হয়। বড়-তরফের সত্যনারায়ণ বসু একদিন সকালে লোকজন লইয়া সেখানে মাছ ধরিতে গিয়া দেখিলেন, ছোট-তরফের গদাধর বসু অপর পাড়ে তাঁহার পূর্বেই আসিয়া জেলে নামাইয়া মাছ ধরিতেছেন। সত্যনারায়ণ বসু কৈফিয়ৎ চাহিলেন–তিনি বর্তমানে, তাঁহাকে জিজ্ঞাসা না করিয়া গদাধরের এমন আচরণের হেতু কি? গদাধর তদুত্তরে যাহা বলিলেন, সত্যনারায়ণ বসুর পক্ষে তা সম্মানজনক নয়। কথার মধ্যে একটা শ্লেষ ছিল, সত্যনারায়ণ বসুর বড় ছেলে কলিকাতায় লেখাপড়া করিতে যাইয়া বকিয়া গিয়াছিল–তাহার শখের দেনা মিটাইতে সত্যনারায়ণকে সম্পত্তির কিছু অংশ বিক্রয় কোবালা করিয়া চুয়াডাঙ্গায় কুণ্ডুদের গদি হইতে প্রায় হাজার দুই টাকা সংগ্রহ করিতে হয়।
বসু-বংশের এই শৌখীন ছেলেটির কথা ঘুরাইয়া গদাধর এমনভাবে বলিলেন যাহাতে সত্যনারায়ণের মনে বড় বাজিল। দুজনের মধ্যে সেই হইতে মনোমালিন্যের সূত্রপাত–তারপর উভয় তরফে ছোটবড় মামলা-মোকদ্দমা, এমন কি ছোটখাটো দাঙ্গা পর্যন্ত হইয়া গিয়াছে। মুখ দেখাদেখি অনেকদিন হইতে বন্ধ।
গদাধর বসুর বয়স বত্রিশ-তেত্রিশ। ম্যালেরিয়াগ্রস্ত চেহারা, রং শ্যামবর্ণ, তবে বসুবংশের দৈহিক ধারা অনুযায়ী বেশ দীর্ঘাকৃতি। ম্যালেরিয়ায় বছরের মধ্যে ছ’মাস ভুগিলেও গদাধরের শরীরে খাটিবার শক্তি যথেষ্ট। উভয় তরফের মধ্যে তাঁহারই অবস্থা ভালো। আশপাশের গ্রাম হইতে সুবিধা দরে পাট কিনিয়া মাড়োয়ারী মহাজনদের নিকট বেচিয়া হাতে বেশ দু’পয়সা করিয়াছেন। এই গ্রামেরই বাহিরের মাঠে তাঁহার টিনের চালাওয়ালা প্রকাণ্ড আড়ত। গ্রামের বাহিরে মাঠে আড়ত করিবার হেতু এই যে, আড়তটি যে স্থানে সেটি দুটি বড় রাস্তার সংযোগস্থল। একটি চুয়াডাঙ্গা যাইবার ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের বড় রাস্তা, অপরটি লোকাল বোর্ডের কাঁচা রাস্তা, সেটি বাণপুর হইতে কৃষ্ণনগর পর্যন্ত গিয়াছে। চুয়াডাঙ্গা ও কৃষ্ণনগরগামী পাটের গাড়ি এখান দিয়াই যায়–পথের ধারে গাড়ি ধরিয়া পাট নামাইয়া লইবেন–এই উদ্দেশ্যেই এই উভয় রাস্তার সংযোগস্থলে আড়ত-ঘর তৈরী।
গদাধর বসু বৎসরে বিস্তর পয়সা রোজগার করেন–অর্থাৎ কলিকাতার হিসাবে বিস্তর না হইলেও পাড়াগাঁ হিসাবে দেখিতে গেলে, বৎসরে পাঁচ-ছ’ হাজার টাকা নিট মুনাফা সিন্দুকজাত করার সৌভাগ্য যাহার ঘটে–প্রতিবেশি-মহলে সে ঈর্ষার ও সম্ভ্রমের পাত্র।
গদাধরের প্রকাণ্ড পৈতৃক বাড়ী বট-অশত্থ গাছ গজাইয়া, খিলান ফাটিয়া, কার্নিশ ভাঙিয়া নষ্ট হইয়া গিয়াছে–সেকালের অনেক জানালা-দরজায় চাঁচের বেড়া বাঁধিয়া আবরু রক্ষা করিবার বন্দোবস্ত। তবু সেই বাড়ীতেই গদাধর পুত্র-পরিবার লইয়া চিরকাল বাস করিয়া আসিতেছেন। টাকা হাতে থাকা সত্ত্বেও গদাধর বাড়ী মেরামত করেন না কেন বা নিজের পছন্দমত নতুন ছোট বাড়ী আলাদা করিয়া তৈরী করেন না কেন ইত্যাদি প্রশ্ন মনে ওঠা স্বাভাবিক, বিশেষত যাঁহারা বাহিরের দিক হইতে জিনিসটা দেখিবেন। ইহার কারণ আর যাহাই হউক, গদাধরের কৃপণতা যে নয় ইহা নিশ্চিত, কারণ গদাধর আদৌ কৃপণ নহেন। প্রতি বৎসর তিনি জাঁকজমকের সঙ্গে দুর্গোৎসব ও কালীপূজা করিয়া গ্রামের শূদ্র-ভদ্র তাবৎ লোককে ভোজন করাইয়া থাকেন–গরীবদের মধ্যে বস্ত্র বিতরণও করেন, সম্প্রতি ‘কুসুম বামনীর দ’র উত্তরপাড়ে একটি বাঁধানো স্নানের ঘাট করিয়া দিয়াছেন–তাহাতে মিত্রপক্ষর মতে প্রায় তিনশত টাকা খরচ হইয়া গিয়াছে–তবে শক্রপক্ষ বলে মেজ-তরফ নির্বংশ হইয়া যাওয়ায় উভয় ঘরের সুবিধা হইয়াছে–ভিটার পুরাতন ইটগুলি সত্যনারায়ণ ও গদাধর মিলিয়া দশহাত বাড়াইয়া লুঠ চালাইতেছে। বিনামূল্যে সংগৃহীত পুরাতন ইটের গাঁথুনি বাঁধা-ঘাটে আর কত খরচ পড়িবে? ইত্যাদি।
যাক এসব বাজে কথা।
আসল কথা, গদাধর গ্রামের মধ্যে একজন সঙ্গতিশালী ও সাহসী লোক। একবার গদাধরের বাড়ীতে ডাকাত পড়িয়াছিল। গদাধর হাঁকডাক করিয়া লোকজন জড় করিয়া, নিজে রামদা হাতে লইয়া হৈ-হৈ শব্দে গ্রাম মাতাইয়া ছুটিয়াছিলেন, কিন্তু ডাকাতদের টিকিও দেখা যায় নাই।
একদিন গদাধর আড়তে বসিয়া কাজকর্ম দেখিতেছেন, কাছে পুরাতন মুহুরী ভড় মহাশয় বসিয়া কাগজপত্র লিখিতেছেন, আজ গদাধরের মনটা খুব প্রসন্ন, কারণ এইমাত্র কলিকাতার মহাজন বেলেঘাটার আড়ত হইতে সংবাদ পাঠাইয়াছে যে, তাঁহার পূর্বের পাটের চালানে মণপিছু মোটা লাভ দাঁড়াইবে।